প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২৩, ০৮:০৪ পিএম
শার্লট এফসিকে হারিয়েই লিগস কাপের সেমিফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে লিওনেল মেসির ইন্টার মায়ামি। ৪-০ গোলের হারের পরও যেন দলটা খুশি। মেসির দলের কাছে হারটাও যেন আনন্দের। তাই তো হার ভুলে টুইটারে স্মৃতি রোমন্থনে ব্যস্ত দলটা। তাদের পোস্ট করা ছবি দেখেই জানা গেল শার্লট এফসির এক খেলোয়াড়ের জীবনে জড়িয়ে থাকা মেসির এক অজানা ঘটনা।
সোমবার (১৪ আগস্ট) একটা টুইট করে মেজর লিগ সকারের (এমএলএস) দল শার্লট এফসি। পাশাপশি দুটি ছবি পোস্ট করে তারা। যার একটি ছবিতে দেখা যায় হলুদ জার্সি পরা কয়েকজন শিশুর মাঝখানে বল পায়ে দৌড়াচ্ছেন লিওনেল মেসি। কালো প্যান্ট ও সাদা টি-শার্ট পরা মেসি বল পায়ে সেই শিশুদের আনন্দ বিলাচ্ছেন। পাছের ছবিটিও ফুটবল মাঠের। এই ছবিতে শার্লটের এক খেলোয়াড়ের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার। ছবি দুটি দিয়ে ক্লাবটি লিখেছে `চক্রপূরণ`।
এরপর থেকেই মানুষজনের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে এই ছবি। কীসের চক্রপূরণের কথা বলা হচ্ছে?
তাহলে এর পেছনের গল্পে ফেরা যাক। প্রথম ও দ্বিতীয় ছবিটিতে মেসি ছাড়াও আরও একজন কমন। তরুণ বয়েসী মেসির সঙ্গে হলুদ জামা পরা শিশুদের একজন আছেন পরিণত বেলার মেসির ছবিটিতেও। যার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন, তিনিই প্রথম ছবিটির শিশুদের একজন। বড় হয়ে খেলছেন শার্লট এফসিতে। নাম তার ক্রিস হেগার্ড।
২০০২ সালে জন্ম নেওয়া হেগার্ড ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বিভাগের ক্লাব তাকোমা ডিফায়েন্সের হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করে গত বছর যোগ দেন শার্লট এফসিতে। এদিন অবশ্য তিনি ইন্টার মায়ামির বিপক্ষে ম্যাচে মাঠে ছিলেন না। ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজার পর বেঞ্চ থেকে উঠে এসে মেসির সঙ্গে হাত মেলান।
এই ম্যাচের আগে `ফক্স৫` কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হেগার্ড বলেন, `এ ম্যাচে মেসির সঙ্গে দেখা হওয়ার মধ্য দিয়ে তার চক্রপূরণ হবে।` কিন্তু এ চক্রপূরণ কীসের?
Full circle moment ✨11-year-old Chris Hegardt met Leo Messi in Barcelona through @MakeAWish after he was diagnosed with childhood cancer.
10 years later he got to meet him again, this time as a professional on the pitch. pic.twitter.com/V1wfR5JTvf— Charlotte FC (@CharlotteFC) August 13, 2023
হেগার্ডের অতীত জীবনের দুঃসহ দিনে মেসি এসেছিলেন আনন্দের দূত হয়ে। মাত্র আট বছর বয়সে লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন হেগার্ড। মারণ রোগের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় তার চিকিৎসায় এগিয়ে আসে `মেক অ্যা উইশ` নামের একটা দাতব্য ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের একটা লক্ষ্য হচ্ছে, আড়াই থেকে ১৮ বছর বয়সী জটিল রতোগে আক্রান্ত বাচ্চাদের ইচ্ছা পূরণ করা। হেগার্ডের বয়স যখন ১১ বছর তখন তার একটা ইচ্ছা পূরণ করে ফাউন্ডেশনটি। সেখানেই শুরু এই চক্রের।
২০১৩ সালে হেগার্ডসহ জটিল রোগেয়াক্রান্ত ১২ শিশুকে বার্সেলোনায় নিয়ে যায় `মেক অ্যা উইশ` ফাউন্ডেশন। ইএসপিএনের মতে, সেখানে যারা ছিল তাদের অনেকেই ছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী। তাদেরই অতিথি হয়েছিলেন মেসি। সেখানেই ক্যানসার আক্রান্ত হ্যাগার্ডের সঙ্গে পরিচয় মেসির। বল পায়ে হেগার্ডের কারুকাজ মুগ্ধ করে মেসিকে। দ্রুতই তিনি মেসির নজর কাড়েন। বিশ্বনন্দিত তারকা জিজ্ঞেস করেন, ছেলেটি কী রোগে ভুগছে? দারুণ `সিজার্স কিক` নেওয়া হেগার্ড কোনো রোগে ভুগছেন এটা বিশ্বাসই হয় না মেসির। তখনই হয়ত মেসি জেনেছিলেন হেগার্ডের ক্যানসারে ভোগার কথা।
ইএসপিএন ২০১৩ সালে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, সাত বছর বয়সী হেগার্ড যুক্তরাষ্ট্রের সেরা উঠতি ফুটবল প্রতিভা। সে বয়সেই তিনি নাকি ১৮ বছর বয়সীদের মতো খেলতে পারতেন। হেগার্ডের এই প্রতিভা দেখেই তার বাবা-মা তাকে আট বছর বয়সীদের লিগে ভর্তি করে দেন।
ফুটবলপাগল হ্যাগার্ড সেই সময় ম্যাচের আগের দিন রাতে জার্সি পরেই ঘুমাত। খুচরো টাকা পেলেও তা খেলার সরঞ্জামাদি কিনতে জমিয়ে রাখতেন। সারা বাড়িময় ফুটবল খেলে সবাইকে অতিষ্ট করে তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু তলে তলেই ভয়াবহ এক রোগ বাড়ছিল হেগার্ডের শরীরে। আর সেই রোগ ধরাও পড়ে ফুটবলের কারণে।
২০০৯ সালের ৫ ডিসেম্বর স্থানীয় এক টুর্নামেন্টে ফলব্রুক ফিউরির হয়ে খেলার সময় পেটে বলের আঘাতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। প্রায় মিনিটখানেক পর উঠে দাঁড়িয়ে আরও ১০ মিনিট খেলে বমি করতে শুরু করেন তিনি। সে সময় মাঠে তার সতীর্থের চিকিৎসক বাবা মাঠে পরীক্ষানিরীক্ষা করেও কিছু ধরতে পারেননি।
পরে ভালোমতো পরীক্ষা করে হেগার্ডের লিভারে টিউমার ধরা পড়ে । বলের আঘাতে সে টিউমার ফেটে যাওয়াতেই এই রক্তপাত। ক্রিসের মা কিমের মতে, সেদিন বলটাই তার জীবন বাঁচিয়েছে। বল না লাগলে তার টিউমারের কথা সময়মতো জানতেই পারতেন না তারা। ক্যানসার ততদিনে তার লিভারের এক তৃতীয়াংশে ছড়িয়ে পড়েছে। সেবার লস অ্যাঞ্জেলেসের হাসপাতালে প্রথম ধাপের কেমো নিয়ে বড়দিনের আগে বাড়িতে ফেরেন হেগার্ড। বড়দিনের উৎসবের দিনে বাড়ি ফিরেই তিনি ক্রিসমাস ট্রির নিচে একটি ফুটবল ও লিওনেল মেসির জার্সি উপহার পান।
পরের ধাপে তার লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়। প্রথমে তার বাবা লিভারের একটা অংশ দিতে চাইলেও অস্ত্রোপচারের দিন ঘটে এক অলৌকিক কাণ্ড। কম বয়সী এক ছেলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যায়, যার লিভার ক্রিসের শরীরে প্রতিস্থাপনের উপযোগী ছিল। ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত বদলে সেই ছেলের লিভার হেগার্ডের শরীরে প্রতিস্থাপন করেন। এর দশদিন পর বাসায় ফেরেন তিনি। ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত কেমোথেরাপি চিকিৎসা শেষে হেগার্ড ফুটবল খেলার ছাড়পত্র পান ।
এরপর অনেক সংগ্রাম করে ফুটবলে ফেরেন হেগার্ড। নতুন করে ক্যারিয়ার শুরু করে এখনও সেই আস্থার প্রতিদান দিতে পারেননি। তবে মেসির সঙ্গে পেশাদার ফুটবল মাঠে দেখা হওয়াটার তাৎপর্য শার্লটের টুইট দেখেই আন্দাজ করা যায়, `১০ বছর পর মেসির সঙ্গে দেখা; এবার পেশাদার ফুটবলের মাঠে।`
মেসির সঙ্গে দেখা হওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে হেগার্ড বলেন, `ছোটবেলায় কখনো ভাবিনি যে ১১ বছর পর তার সঙ্গে ফের দেখা হবে। জীবন কখন ও কীভাবে, কার সঙ্গে আমাদের দেখা করিয়ে দেবে, কেউ জানে না।`
আসলেই কে জানত মেসি মেজর লিগ সকারে খেলতে যাবে একদিন!
সিটি নিউজ ঢাকার ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন
জেকেএস/