
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০২২, ০৩:৩৬ এএম
বাঁশির শেষ সুর। আর তাতেই নির্ধারণ হবে ফুটবল ইশ্বরের ভাগ্য। কী হতে যাচ্ছে সেই শেষ সুরের সঙ্গে, তা নিয়েই উৎকণ্ঠা সর্বজনে। এটাই কী হতে যাচ্ছে তার স্বপ্নভঙ্গের রাত? নাকি স্বপ্ন বেঁচে থাকবে আরও একটি রাতের জন্য, আরও একবার বাঁশির শেষ সুরের জন্য। সেই উৎকণ্ঠা শেষে ভক্তদের নিঃশ্বাস হবে কী স্বস্তির নাকি বিয়োগের, তা জানতে আর অপেক্ষা মাত্র ঘড়ির কাটার কিছু স্থানান্তর। কে সে ফুটবল ইশ্বর, তা হয়তো বুঝার বাকী নেই কারও। তিনি একবিংশ শতাব্দীর ফুটবল যাদুকর। কোটি মানুষের নয়নের স্বস্তি। তিনি লিওনেল মেসি। তার দিকেই তাকিয়ে আছে বিশ্ব। একটি অপূর্ণতা তার জীবনে। তা পূর্ণতা পাবার বাকী আর মাত্র দুটো সিড়ি। সেই সিড়িগুলো পার হলেই মিলবে স্বপ্নের পূর্ণতা। সঙ্গে কোটি মানুষের আনন্দাশ্রু।
শঙ্কা তো রয়েছে বটে। যদি ভাগ্য না সহায় না থাকে। মেসির আর্জেন্টিনা আজ মুখোমুখি ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে। কাতার বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইনালে বাংলাদেশ সময় রাত একটায় মুখোমখি হবে দুইদল। এই ম্যাচে মেসিদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় ক্রোয়েশিয়া। আলবিসেলেস্তেদের চিরপ্রতিদন্ধী ব্রাজিলকে হারিয়েই কিন্তু ফাইনালের লড়াইয়ে এসেছেন তারা। সে কারণে একটু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে মেসিদের।
তবে পরিসংখ্যান অনেকটাই এগিয়ে মেসির স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার পথে। কেননা এখনও বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে কখনও হারেনি ম্যারাডোনা, রিকুয়েলমে কিংবা মেসিদের আর্জেন্টিনা। সেই পুনরাবৃত্তির আশা করছেন ভক্ত ও সমর্থকরা।
এখন পর্যন্ত চারটি বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলেছে তারা। যেখানে কখনই হারেনি আলবিসেলেস্তেরা। বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম আসরেই সেমিফাইনালে অংশ নেয় আর্জেন্টিনা। এরপর ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপ, ১৯৯০ সালের ইতালি বিশ্বকাপ এবং ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপ।
১৯৭৮ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তুললেও সেবারের টুর্নামেন্টের ফরম্যাটটা ছিল ভিন্নরকম। আর্জেন্টিনায় হওয়া সে বিশ্বকাপে প্রথমে ১৬টা দল ৪ গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলে। সেই চার গ্রুপের আট দল আবার দ্বিতীয় রাউন্ডে দুই গ্রুপে ভাগ হয়। এই দুই গ্রুপের সেরা দুই দল খেলে ফাইনাল। তাই আর সে বছর আলাদা করে সেমিফাইনাল খেলতে হয়নি আলবিসেলেস্তেদের।
ফুটবল ইশ্বরের কথা যদি বলতে হয় তাহলে ফিরে যেতে হবে রোজারিও শহরে। ১৯৮৭ সালের ২৪ জুন সেই শহরেই জন্মেছিলেন এই কিংবদন্তী। পুরো নাম তার লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। অনেকে আদর করে ডাকেন ‘লিও মেসি’।
মেসির বাবা হোসে মেসি ছিলেন একটি স্টিলের কারখানার ম্যানেজার। মা ফেলিয়া কুচিতিন কাজ করতেন একটি চুম্বক বানানোর কারখানায়। চার ভাই বোনের মাঝে তৃতীয় মেসি। বাবার দিক থেকে মেসি ইতালি ও স্পেন থেকে অভিবাসী। একেবারে ছোট থেকে ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা দেখা যায় মেসির। মাতিয়ে রেখেছিলেন রোজারিও শহরের সেই ছোট্ট গলি। স্থানীয় ক্লাব গ্রান্দোলির কোচ ছিলেন বাবা। বাবার দলেই পাঁচ বছর বয়সে ছোট্ট মেসি যাত্রা শুরু করেন ফুটবলার হয়ে।
এরপর চলে যান তার দেশের “নিউওয়েল’স ওল্ড বয়েজে’। সেখানে থেকেই একজন প্রতিভাবান ফুটবলারের সব দক্ষতা, নৈপুণ্য ও যোগ্যতার ঝলক দেখান ফুটবল বিশ্বে। কিন্তু তখনই হানা দেয় এক শঙ্কা। মাত্র ১১ বছর বয়সেই কী হয়ে যাবে ইতির। জীবন আটকে যায় তার মুত্যুর করাল থাবায়। বেড়ে উঠার সময় আক্রান্ত হয়েছিলেন হরমোনের একটি জটিল রোগে। ফলে জীবন বাঁচাতে সুদীর্ঘ ও খুব ভালো চিকিৎসার প্রয়োজন তার।
মেসির চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য ছিল না তার গরিব বাবা-মায়ের। হয়তো থেমে যেতে পারতো তখন তার এলএম টেন হওয়ার দৌড়। কিন্তু যিনি একদিন ফুটবল বিশ্বে রাজত্ব করবেন তার সঙ্গে কী সৃষ্টিকর্তা থাকবেন না? সৃষ্টিকর্তা বঞ্চিত করেননি একুশ শতকের ফুটবল ভক্তদের।
ফুটবলে তার অসাধারণ যোগ্যতায় নজর কাড়ল বার্সেলোনার। তাই তাকে নিয়ে তার মা-বাবা পাড়ি জমান বার্সেলোনায়। আর সেখানেই হয় চিকিৎসার। ১৭ বছর বয়স থেকে বার্সেলোনার হয়ে নজর কাঁড়েন সবার। ১৮ বছর বয়স থেকে তিনি আর্জেন্টিনার অন্যতম প্রাণভোমরা। এরপরের ইতিহাস ফুটবল ভক্তদের সবার জানা। পেয়েছেন অনেক। ব্যাক্তিগত আরও বার্সেলোনার হয়ে ট্রফি জিতেছেন অসংখ্য। তবে সব প্রাপ্তির মাঝে অপ্রাপ্তি ছিলো নিজ দেশের হয়ে একটি শিরোপার। যদিও ২০২১এ কোপা শিরোপা এবং ২০২২ সালে এসে জয় করেছেন ফাইনালিসিমা।
কিন্তু এখনও অধরা বিশ্বকাপের শিরোপা। ২০১৪ বিশ্বকাপে শিরোপার খুব কাছাকাছি গিয়েও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে ফিরতে হয়েছিল তাকে। এবার হয়তো মেসির শেষ বিশ্বকাপ। এটাই মেসির জন্যও সোনালি ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখার শেষ সুযোগ। সেই মুহুর্তটির দ্বারপ্রান্তে এখন মেসি। তবে সেই পথের প্রথম বাধা এখন ক্রোয়েশিয়া। ক্রোয়েটদের বধ করতে পারলেই বাকী থাকবে আর একটি সিড়ি। তা পার করতেই বিশ্বকাপ শিরোপা পাবে অমরত্নের স্পর্শ। তবে মেসির হাতে শিরোপার পথে থাকা বাধা ঘোচাতে মরিয়া স্ক্যালোনি বাহিনী।
ক্রোয়েটদের বিপক্ষেই যেহেতু ম্যাচ তাই দুই দলের মুখোমুখির পরিসংখ্যানের কথাও অবশ্য বলতে হবে। আর্জেন্টিনা ও ক্রোয়েশিয়া এখন পর্যন্ত মুখোমুখি হয়েছে ৫ ম্যাচে। যেখানে দুই দলের জয়ই দুটি করে। একটি ম্যাচ ড্র হয়েছে। রাশিয়া বিশ্বকাপে নিজেদের সবশেষ দেখায় ৩-০ গোলে জিতেছিল ইউরোপের দেশটি। পাঁচবারের দেখায় দুদলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গোল করেছে ক্রোয়াটরা। তাদের ৬ গোলের বিপরীতে আলবিসেলেস্তেদের গোল ৫টি।
তবে এসব পরিসংখ্যান কিছুই নয় মাঠের খেলায়। দলনেতার শেষ বিশ্বকাপে শিরোপা উপহার দিতে মরিয়া আলবিসেলেস্তেরা। তবে থেমে নেই আরেক কিংবদন্তী, মধ্যমাঠ কাঁপিয়ে বেড়ানো লুকা মদ্রিচ। সতীর্থদের নিয়ে তিনিও চাইবেন বাঁশির শেষ সুরের সঙ্গে হাঁসিটা তাদের হোক। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা কী চাইছেন এই যাদুকরের বিদায়টা আনন্দাশ্রুতে হোক? তা হয়তো অজানা। কিন্তু সেটাই হোক, এমনটাই মেসিভক্তদের কামনা।
এআরআই