প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২২, ০৯:৩৭ এএম
এবারের এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার শুরুটা হয়েছিল হতাশার মধ্য দিয়ে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে নাকানিচুবানি খেয়ে বড় পরাজয়। অনেকটা অনিশ্চিত ছিল সুপার ফোর নিশ্চিত করা। যদিও বাংলাদেশের বাজে পারফর্মেন্স এর কারণে সুপার ফোর নিশ্চিত করে মেন্ডিস রাজাপাকসেরা। আর তারপর যা ঘটেছে তা সবারই জানা। হতাশায় শুরু করা দলটি টুর্নামেন্ট শেষ করেছে চ্যাম্পিয়ন হয়ে।
বেশ কয়েক মাস যাবৎ অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্রটি। এশিয়া কাপের এবারের আসরটি শ্রীলঙ্কাতেই আয়োজনের কথা ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তা আর হয়ে উঠেনি। তবে লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ডের আয়োজনেই আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত হয় টুর্নামেন্টটি।
আসরে সবচেয়ে অনভিজ্ঞ দল ছিল শ্রীলঙ্কা। দলে নেই তেমন কোনো আলোচিত ক্রিকেটার। কোয়ালিফাই রাউন্ডে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে ১০৫ রানে অলআউট হয়ে যায় শ্রীলঙ্কা। ব্যাট করতে নেমে ৫৯ বল হাতে রেখেই ৮ উইকেটে জয় তুলে নেয় আফগানরা। সেই ম্যাচের পর অবশ্য কেউ চিন্তাও করতে পারেনি সুপার ফোরে জায়গা পাবে লঙ্কানরা, শিরোপা জয় তো দূরের কথা!
কিন্তু টিম ওয়ার্ক থাকলে যেকোনো কিছুই যে করা সম্ভব তার প্রমাণ দিয়েছে লঙ্কানরা। টুর্নামেন্ট জুড়ে লঙ্কানদের ৬ ম্যাচের মাঝে কেবল ওই একটি ম্যাচই পরাজয় ছিল।
জয়ের শুরু হয় বাংলাদেশকে হারিয়ে। বাংলাদেশের দেয়া ১৮৪ রানের বড় লক্ষ্যকে তাড়া করতে নেমে ৮ ওভার ৫ বলে মাত্র ৭৭ রানে ৪ উইকেট হারায় লঙ্কানরা। কিন্তু দলনেতা কুশাল মেন্ডিসের ৩৭ বলে ৬০ রানের ইনিংস জয়ের ভিত গড়ে দেয়। সেই সঙ্গে দাসুন শানাকার ৩৩ বলে ৪৫ রানের ইনিংস ও আসিথা ফারনান্দোর ৩ বলে ১০ রানের ক্যামিওতে সুপার ফোর নিশ্চিত করে শ্রীলঙ্কা। ২ উইকেটে বাংলাদেশকে হারিয়ে আসরে জয়ের সুচনা পায় লঙ্কানরা। তবে সেই জয়ের পর আর পরাজয় বরণ করতে হয়নি তাদের।
সুপার ফোরে নিজেদের প্রথম ম্যাচে আবারও আফগানদের মুখোমুখি হয় লঙ্কানরা। এবার আফগানদের নিকট থেকে প্রতিশোধ নেয় মেন্ডিস-হাসারাঙ্গারা। আফগানদের দেয়া ১৭৬ রানের চ্যালেঞ্জকে ৬ উইকেট খরচায় ৫ বল হাতে রেখেই জয় তুলে নেয় তারা। সে ম্যাচেই তরুণ দলটির আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠেছিল।
আর সেই আত্মবিশ্বাস আরও পরিণত হয়েছে ভারতকে হারিয়ে। নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে আসরের হট ফেভারিট ভারতের দেয়া ১৭৪ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শানাকার ১৮ বলে ৩৩ রানের ঝড়ো ইনিংসে ১ বল হাতে রেখে ৬ উইকেটে জয় তুলে নেয় লঙ্কানরা। সে ম্যাচে নিশানকা ও মেন্ডিস দুজনেই খেলেছিল অর্ধশত রানের ইনিংস।
আফগান ও ভারতীয়দের হারিয়ে আসরে সবার আগেই ফাইনালের পথ সুগম হয়ে যায় লঙ্কানদের।
নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে আফগানদের বিপক্ষে পাকিস্তান জয় তুলে নেয়ায় ফাইনাল নিশ্চিত হয় দুই দলেরই।
ফাইনালের আগে নিয়ম রক্ষার ম্যাচে মুখোমুখি হয় পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। সে ম্যাচে অবশ্য পূর্ণ শক্তি নিয়ে মাঠে নামেনি রিজওয়ান-বাবররা। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানকে হারিয়ে কিছুটা ব্যাকফুটে হতে বাধ্য করে লঙ্কানরা। মাত্র ১২১ রানেই পাকিস্তানকে অলআউট করে শ্রীলঙ্কা। আর ১৮ বল হাতে রেখেই ৫ উইকেটে জয় তুলে নেয়।
আর সেই জয়ে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় তারুণ্যে ভরা লঙ্কানদের। ফলে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে সেই আত্মবিশ্বাস কাজে লাগিয়ে ৬ষ্ঠ বারের মত এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরে দ্বীপ রাষ্ট্রটি।
এবার আসা যাক ফাইনাল ম্যাচ নিয়ে। ডুবাইয়ের উইকেটে জয়-পরাজয়টা অনেকটা নির্ভর করে টসের উপরে। সেখানে টসে জয় পায় শিরোপা জয়ে হট ফেভারিট পাকিস্তান। টস জিতে শ্রীলঙ্কাকে ব্যাটে পাঠায় পাক কাপ্তান।
সর্বশেষ গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে এ পর্যন্ত ২২টি ম্যাচের মধ্যে কেবল চারটিতে প্রথম ব্যাট করা দল জয় পেয়েছে, হেরেছে শেষে ব্যাট করা দল।
ফাইনাল হলে তো কথাই নেই, টস জয় মানেই ম্যাচ জয়। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কিংবা আইপিএল- যাই বলুন না কেন। এই এশিয়া কাপেও এই মাঠে ফাইনালের আগে দুটি বাদে বাকিগুলোর প্রতিটিতেই জিতেছে টসজয়ী দল। হংকং এবং আফগানিস্তানের বিপক্ষে টস হেরেও ম্যাচ জিতেছিল ভারত।
কিন্তু এশিয়া কাপের ফাইনালে কী ঘটলো? টস জিতেও এর সুবিধাটা কাজে লাগাতে পারেনি পাকিস্তান। বরং, তাদের অসংখ্য ভুলেরর সুযোগটা ভালোভাবেই গ্রহণ করেছে শ্রীলঙ্কা এবং শিরোপা জয় করে নিয়েছে।
ম্যাচের শুরুতেই কাপ্তানের সেই সিদ্ধান্তকে অনেকটা সঠিক প্রমাণ করে দেয় পাকিস্তানের বোলাররা। শুরুতেই নাসিম শাহের দুর্দান্ত বোলিং। প্রথম ওভারেই কুশল মেন্ডিসের স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিয়ে শুরু পাকিস্তানের। এরপর পাথুম নিশঙ্কাকে বাবর আজমের হাতে ক্যাচ দেয়ার পর দানুসকা গুনাথিলাকার উইকেট যেভাবে উপড়ে ফেলেছিলেন হারিস রউফ, তাতে মনে হয়েছিল পাকিস্তানের সামনে টিকতেই পারবে না শ্রীলঙ্কা।
৫৮ রানে ৫ উইকেট পড়ার পর তো এই ধারণা আরও নিশ্চিত হয়েছিল। কিন্তু সবার ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করতে ৫৮ রানের জুটি গড়েন ওয়ানিদু হাসারাঙ্গা এবং ভানুকা রাজাপাকসে। আর তাতেই ম্যাচে প্রাণ ফিরে পায় শ্রীলঙ্কা। সেই সঙ্গে বোনাস হিসেবে পাকিস্তানের মিস ফিল্ডিং আর ক্যাচ মিস তো রয়েছেই।
শাদাব খান ক্যাচ মিস করেন, বাউন্ডারির সামনে দাঁড়িয়ে আসিফ আলি ক্যাচ ধরতে যান, সেখানে গিয়ে ধাক্কা দেন শাদাব, বল বাউন্ডারির বাইরে গিয়ে ৬ হয়। শেষের দিকে লুজ বোলিং- যেখানে প্রথম ১০-১২ ওভার পুরোপুরি পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রনে, শ্রীলঙ্কা ১০০ করতে পারে কিনা, সেটা অনিশ্চিত ছিল। কিন্তু সেখানে ম্যাচ তো লঙ্কানরা বের করেছেই। উল্টো ১৭০ রান করে ম্যাচটে পুরোপুরি নিজেদের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে।
এরপর বোলিংয়ের এসে পুরোপুরি এলোমেলো শ্রীলঙ্কা।প্রথম ওভারে মধুশঙ্কা কোনো বল ছাড়াই ৯ রান দেয়ার পর ওভারের বাকি ৬ বলে পাকিস্তানের দুই ওপেনার বাবর আজম এবং মোহাম্মদ রিজওয়ান নিতে পারলেন কেবল ৩ রান। পুরো ওভার শেষে পাকিস্তানের স্কোরবোর্ডে যোগ হয় মাত্র ১২ রান।
পরিস্থিতি দ্রুত নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে পাকিস্তানের রান আটকে রাখে লঙ্কানরা। একইসঙ্গে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট ফেলতে থাকে তারা। যার গতি বেড়েছিল শেষ মুহূর্তে এসে। অথচ, লঙ্কানদের শুরুর এলোমেলো পরিস্থিতির সুযোগটা নিতে পারতো পাকিস্তান। এমনকি ফাইনালের মত ম্যাচে এ ধরনের সুযোগই নিয়ে থাকে যে কেউ।
কিন্তু পুরো ম্যাচেই সুবর্ণ সুযোগগুলো হাতছাড়া হয়েছে পাকিস্তানের। যার ফলশ্রুতিতে টপ ফেবারিট হয়েও শিরোপা জিততে পারলো না পাকিস্তানিরা। অন্যদিকে পুরোপুরি আন্ডাররেটেড দল হিসেবে খেলতে এসে চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরলো শ্রীলঙ্কা।
এআরআই