
প্রকাশিত: জানুয়ারি ৬, ২০২২, ০৩:০৮ এএম
ক্রিকেটকে বলা হয় ভদ্রলোকের
খেলা। কিন্তু ভদ্রলোকের খেলাকেই বারবার কালি মেখে দিয়েছেন স্বয়ং ক্রিকেটাররাই। এখন
কী আন্তর্জাতিক, কী ঘরোয়া সবখানেই চোখ থাকে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা
আইসিসির। কারণ ওই একটাই, ভদ্রলোকের খেলাটির গায়ে ফের যেন কেউ
কালি মেখে দিতে না পারে৷ আমরা এই প্রতিবেদনে দেখব কোন কোন নামী ক্রিকেটার খেলাটির
গায়ে কলঙ্কের দাগ লাগিয়েছিলেন।
সেলিম মালিক : ক্রিকেটে পাকিস্তানকে বলা হয়ে থাকে আনপ্রেডিক্টেবল। এ দলটিকে নিয়ে আপনি আগাম কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবেন না। তারা কখন কী করে বসেন নিজেরাও জানেন না। ক্রিকেটে তাদের চরিত্রটাই এমন। এই পাকিস্তানেরই বিখ্যাত ক্রিকেটার সেলিম মালিক সর্বপ্রথম নিষিদ্ধ হন। ১৯৯৪-৯৫ সালের কথা। করাচি টেস্টে হারের জন্য দুই শেন ওয়ার্ন ও মার্ক ওয়াহকে ঘুষ দেন মালিক, যা প্রমাণ হয় ২০০০ সালে এসে। ফলে আজীবন নিষিদ্ধ হন মালিক। একই অপরাধে তাকে জেলেও যেতে হয়েছে। অবশ্য রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পান মালিক ২০০৮ সালে। ততদিনে ক্রিকেট ক্যারিয়ার তার শেষ হয়ে গেছে।
মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন : আর মাত্র একটি টেস্ট বাকি ছিল শততম টেস্ট ম্যাচের জন্য। সেটা হয়নি ভারতের অন্যতম সেরা অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের৷ তার আগেই ফিক্সিংকাণ্ডে আজীবন নিষিদ্ধ হন। ১৯৯৬ সালে কানপুর টেস্টে জুয়াড়ির মাধ্যমে তৎকালীন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রোনিয়েকে অর্থ দেয়ার অভিযোগ ওঠে আজহারের বিরুদ্ধে। দীর্ঘ সময় তদন্ত করে ২০০০ সালে এসে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয় আজহারকে। এই কলঙ্ক থেকে প্রাক্তন ভারতীয় অধিনায়কের মুক্তি মেলে ২০১২-তে গিয়ে৷ অন্ধ্রপ্রদেশের আদালত আজহারের রায়ের কোনো প্রমাণ খুঁজে পায়নি৷
হ্যান্সি ক্রোনিয়ে : আজহারউদ্দিনের ঘটনায় নাম উঠে আসে হ্যান্সি ক্রোনিয়েরও। ভারতে ওই সিরিজের পর দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরতি সফর ছিল আজহারউদ্দিনদের৷ সেই সিরিজে দলের হাঁড়ির খবর পাচার করার জন্য নাকি ক্রোনিয়েকে ৫০ হাজার ডলার দেয়া হয়েছিল। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, ২০০০ সালেও তার জুয়াড়িদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল এমন অভিযোগ ছিল। এসব বিষয় নিয়ে তদন্তের পর জানা যায়, ক্রোনিয়ের জুয়াড়ি কানেকশন সত্যি। ফলে আজহারের মতো তাকেও আজীবন নিষিদ্ধ করা হয়৷ এর দুই বছর বাদে ২০০২ সালে এক বিমান দুর্ঘটনায় পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নেন ক্রোনিয়ে।
সালমান বাট, মোহাম্মদ আসিফ ও মোহাম্মদ আমির : পাকিস্তান ক্রিকেটকে সবচেয়ে বেশি কলঙ্কিত করেছেন সালমান বাট, মোহাম্মদ আসিফ ও মোহাম্মদ আমির। ২০১০ সালে লর্ডস টেস্টে আসিফ ও আমির ইচ্ছাকৃতভাবে ‘নো’ বল করেন। আগে ফিক্সিংয়ের কথাই শোনা গেছে। আমির-আসিফ যেটা করেছেন সেটা ‘স্পট ফিক্সিং’। আর এই দুজনের গুরু তৎকালীন পাকিস্তান অধিনায়ক সালমান বাট। তার কথামতো নির্দিষ্ট ওভারে ‘নো’ বল করেছিলেন আমির ও আসিফ। পরে তাদের জবানবন্দিতেই এই কুকর্ম প্রমাণিত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে আমিরকে ৫ বছর, আসিফকে ৭ বছর ও বাটকে ১০ বছর করে ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আমির আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরলেও আসিফ ও বাটের পক্ষে তা এখনও সম্ভব হয়নি।
মোহাম্মদ আশরাফুল : বাংলাদেশের ক্রিকেটাররাও যে ফিক্সিং কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন, সেটি মোহাম্মদ আশরাফুলের ঘটনার আগে কেউ বোধহয় বিশ্বাস করতেন না। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) চলার সময় ফিক্সিংয়ে জড়ান আশরাফুল। পরে নিজেই আইসিসির তদন্ত দলের নিকট সব গড়গড় করে বলে দেন তিনি। ফলে ৮ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন বাংলাদেশের প্রথম সুপারস্টার। আশরাফুল আপিল করলে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ ৮ থেকে ৫ বছরে নেমে আসে। নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি এখন ঘরোয়া ক্রিকেট খেলছেন। আবার আশরাফুলকে জাতীয় দলে দেখা যাবে কি না সেটা সময়ের ওপর ছেড়ে দেয়াই ভালো।
লু ভিনসেন্ট ও কৌশল লুকুয়ারাচ্চি : ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পেয়েও সঠিক সময়ে কর্তৃপক্ষকে না জানানোয় নিউজিল্যান্ডের প্রাক্তন ক্রিকেটার লু ভিনসেন্ট ও শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটার কৌশল লুকুয়ারাচ্চিকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। ২০১৩ সালে বিপিএল চলাকালে দুজনেই এই অপরাধ করেছিলেন। এ জন্য ভিনসেন্টকে ৩ বছর ও লুকুয়ারাচ্চিকে ১৮ মাসের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে ভিনসেন্টের বিরুদ্ধে অন্য লিগগুলোতেও ফিক্সিংয়ের প্রমাণ মিলেছিল। যে কারণে তাকে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয়।
হেনরি উইলিয়ামস ও হার্শেল গিবস : এ দুই দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার একটু অন্যভাবে শাস্তি পেয়েছেন। হেনরি উইলিয়ামস এবং হার্শেল গিবসও নিজেদের ফিক্সিংয়ে যুক্ত করেছিলেন। তারা জুয়াড়িদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েও তাদের কথামতো খেলেননি। তাদের খারাপ পারফর্ম করার কথা ছিল৷ উইলিয়ামস ও গিবস এর উল্টোটাই করেছেন। আইসিসি তবুও তাদের ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল।
সনাৎ জয়াসুরিয়া : যখন খেলতেন তখন কোনো কলঙ্কের দাগ লাগেনি সনাৎ জয়াসুরিয়ার। ক্রিকেট ছাড়ার পর শ্রীলঙ্কা দলের প্রধান নির্বাচক হন তিনি। ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কা-জিম্বাবুয়ে ওয়ানডে সিরিজের চতুর্থ ম্যাচে ফিক্সিংয়ের অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে আইসিসি জয়াসুরিয়ার নিকট সহযোগিতা চায়৷ কিন্তু মাতারা হ্যারিকেন সহযোগিতা না করে বারবার এড়িয়ে গেছেন। এ ছাড়া জয়াসুরিয়ার কাছে প্রমাণ চাওয়া হলে তিনি তার মোবাইল ফোন নষ্ট করে ফেলেন। আলামত নষ্ট করার অভিযোগে জয়াসুরিয়াকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে আইসিসি।
সাকিব আল হাসান : জুয়াড়ির তথ্য গোপন করার দায়ে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন বাংলাদেশের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। আশরাফুলের পর এই ঘটনা বাংলাদেশের ক্রিকেটে বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে। ২০২০-এর ২৯ অক্টোবর সাকিব নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ওয়ানডে সিরিজে ফিরেই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন সাকিব। পরের বছর (২০২১) ঘরোয়া ক্রিকেটে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে অখুশি হয়ে লাথি মেরে স্ট্যাম ভেঙে ফেলেন তিনি। যা নিয়ে দেশে ও বিদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। পরে সাকিবের বিরুদ্ধে লেভেল-৩ পর্যায়ের আচরণবিধি ভাঙার অভিযোগ এনে তাকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা ও তিন ম্যাচের বহিষ্কারাদেশ দেয় ক্রিকেট কমিটি অব ঢাকা মেট্রোপলিস (সিসিডিএম)।
স্টিভ স্মিথ ও ডেভিড ওয়ার্নার : ২০১৮ সালের মার্চে কেপটাউন টেস্টের ঘটনা। বল টেম্পারিংয়ের জন্য এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন তখনকার অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ ও সহ-অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার। সরাসরি যুক্ত না থাকায় ৯ মাসের জন্য নিষিদ্ধ হন ক্যামেরন বেনক্রাফট। স্মিথ এবং ওয়ার্নারের পরামর্শে মাঠে শিরিষ কাগজ নিয়ে ঢুকেছিলেন বেন ক্রাফট। মাঠে গিয়ে তিনি বলের ওপর ঘষতে থাকেন, যা ক্যামেরার চোখে ঠিকই ধরা পড়ে যায়। পরে স্মিথ সংবাদ সম্মেলনে নিজেই বল বিকৃতির কথা স্বীকার করে নেন, যা গোটা ক্রিকেট দুনিয়ায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
করোনাবিধি ভেঙে নিষিদ্ধ শ্রীলঙ্কার ৩ ক্রিকেটার : ২০২১ সালের জুনে ইংল্যান্ড সফরে যায় শ্রীলঙ্কা। টি-টোয়েন্টি সিরিজ চলাকালে ডারহামের রাস্তায় কুশল মেন্ডিস ও ডিকভেলাকে ঘুরতে দেখা গেছে। একপর্যায়ে দুজনকে ধূমপানের পাঁয়তারা করতেও দেখা যায়। এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। করোনার মাঝে হোটেলের কড়াকড়ি ও বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে তারা কীভাবে বাইরে ঘুরে বেড়ালেন তা নিয়ে শুরু হয় তীব্র সমালোচনা।
জৈব সুরক্ষা বলয় ভেঙে শাস্তির মুখে পড়েন কুশল মেন্ডিস, নিরোশান ডিকাভেলা এবং দানুশকা গুনাথিলাকা। তিনজনকেই নিষিদ্ধ করে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ড। শুধু তাই নয়, তাদের ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
টিম পেইন : ২০২১ সালের নভেম্বরে নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটার টিম পেইন। তাসমানিয়ার এক নারী কর্মীকে যৌন উত্তেজক বার্তা পাঠিয়ে অজি টেস্ট দলের অধিনায়কত্ব হারিয়েছেন এই উইকেটরক্ষক ব্যাটার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে পেইন বলেন, 'আজকে আমি অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট দলের নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগের ঘোষণা করছি। অবিশ্বাস্য রকমের কঠিন সিদ্ধান্ত এটি। তবে সঠিক সিদ্ধান্ত আমার জন্য, আমার পরিবারের জন্য ও ক্রিকেটের জন্য।'
যদিও ঘটনাটি ঘটেছে ২০১৭ সালের নভেম্বরে। ওই সময় ক্রিকেট তাসমানিয়ার এক নারী কর্মীকে কিছু যৌন উত্তেজক বার্তা ও অশ্লীল ছবি পাঠিয়েছিলেন পেইন। সেই নারী কর্মী বিষয়টি ক্রিকেট তাসমানিয়া ও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে জানান। এটা নিয়ে তদন্তও হয়। কিন্তু ক্রিকেট তাসমানিয়া ও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার কারও কাছেই তখন মনে হয়নি যে পেইন আচরণবিধি ভেঙেছেন! পেইনকে তারা কোনো ধরনের শাস্তি না দিয়েই ছেড়ে দেন।
চার বছর পর বিষয়টি সবার সামনে নিয়ে আসে অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম নিউজ কর্প। এরপর অন্য সব সংবাদমাধ্যমেও এ নিয়ে খবর ছাপা হয়েছে। তুমুল সমালোচনার মধ্যেই পেইন অস্ট্রেলিয়ার নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।
জেডআই/এম. জামান