প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২৩, ০৫:৩৭ পিএম
ছোট সময়টা কেটেছে নানাবাড়িতে। নানী সব আবদারই মেনে নিতেন।একটা ব্যাপার নিয়ে হতো ঝামেলা। নানা স্বাদের ইফতার থাকতো রোজার সন্ধ্যায়।প্রথম রোজার চাঁদ দেখা হতো পশ্চিমের রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে। রাস্তার পশ্চিমে দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ।তার শেষপ্রান্তে আকাশে চাঁদ উঠলে খুব সহজেই দেখা যেতো। এই চাঁদের খবর পেয়ে নানীকে ধরতাম ইফতারের জন্য। নানী বলতেন, পরের দিন।আমি কিছুতেই মানতে চাইতাম না।রোজা শুরু হয়ে গেছে। ইফতার কেন করবো না?
কি ছিল সেই মনোহর ইফতার? মূলত মুড়ির মোয়া আর গরুর দুধ।মাঝে মাঝে ছাতু,দুধে ভিজানো।
শুধু হাটের দিন বাজার থেকে পাতায় মোড়ানো ভিজা বুট(ছোলা)!
কালে কালে সব বদলেছে। মুড়ি চিড়ার দিন ও গেছে। ভিজা বুট হয়েছে `ছোলা`।ইস্তার বা ইস্তারি হয়েছে `ইফতার `! বেহেন রাইতের খানা হয়েছে সেহরি > `সাহরি`। তখন বাহারি ইফতার করার সামর্থ্য `বড় বাপের পোলা`দের ও ছিল না।অধিকাংশ মানুষই ভগ্নস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ায় রোজায় যেত দুর্বল হয়ে। শুয়ে ঘুমিয়ে দিনের অনেকটা পার করতো।বাধ্য হয়ে যাকে কাজ করতে হতো তার মেজাজ থাকতো তিরিক্ষি। লোকে বলতো,`রোজায় ধরেছে `!
তখন ইফতারে গলা পর্যন্ত না খাওয়ায় মাগরিবের পর পরই খাওয়া হয়ে যেতো। আখাউড়ায় আব্বা দেখতাম এরপর দীর্ঘ সময়ের জন্য চলে গেছেন তিতাস নদীর পারের মসজিদে। আব্বার মুখেই শুনেছি, দীর্ঘ বিশ রাকআত নামাজে মানুষ যাতে আগে পিছে না চলে যায় এজন্য দড়ি বেঁধে রাখা হয় লম্বালম্বি। মুসল্লিরা তার ভেতর পা দিয়ে দাঁড়ায়।অনেক রাতে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম, আম্মা একটার দিকে ঘুম থেকে উঠে গেছেন।লাকড়ির চূলায় চোঙ্গা (হুঁ চুঙ্গা) দিয়ে আগুন জ্বালাতে ফুঁ দিচ্ছেন। রান্না,খাওয়া শেষ করে আড়াইটা,তিনটার মধ্যে আবার ঘুমাতেন। সকালে ফজরে উঠলে মোটামুটি ঘুম শেষ।
ঈদের আভাস পেলেই বিহারী ব্যবসায়ী নিজাম সাহেব বা তাঁর জামাই আনোয়ার সাহেব আব্বাকে সম্বোধন করে বলতেন, `ঈদ মোবারক`!এ সব উইশ করার ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে আগে ছিল না।
নিজাম সাহেব ঈদের সকালে পয়সা ছিটাতেন।আক্ষরিক অর্থেই।আমরা ছোটরা একটা নতুন জামা পরে ঘুরে বেড়াতাম। এই তো ঈদ।আনন্দের জন্য কি আর উপকরণ লাগে?
কুমিল্লায় ইফতারের থালা নিয়ে অপেক্ষা করতাম,কখন সাইরেন দিবে। সন্ধ্যার আগে মাঝে মাঝে আসতো বরফঅলা।টুকরো বরফ খড়ের কুটো দিয়ে ছাওয়া।রাতের সাইরেন বাজতো তিন বার।প্রথমে জাগার।পরের টা সতর্কতামূলক।সর্বশেষটিতে খাওয়া বন্ধ।
তখন ও বাজার থেকে কিনে ইফতারের তেমন প্রচলন হয় নি।মুক্তিযুদ্ধের পর ৮০ র দশক থেকে সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে ছোলা,পিঁয়াজু,মুড়ি, বেগুনি, শঁসা।এমন কি আগে হালিম বললেই গ্রামের আবদুল হালিম মিয়ার কথা বুঝতাম।এখন শুনি এ ও এক মজাদার খাবার।ইফতারের অনুষঙ্গ।
ক্যাডেট কলেজের রোজা আবার ভিন্ন রকম।এই এক মাস সকালের পি টি থেকে মুক্তি। সন্ধ্যায় অসংখ্য আইটেমের ইফতার। রোববারে শুরুতেই গোটা এক বোতল ফানটা।তেঁতুল মাখা কাঁচা ছোলা।এ রকম আর কোথাও খাই নি।রাতে তারাবিতে গেলে প্রেপ মাফ।গভীর রাতে আবার ডাইনিং হলে।ইচ্ছেমতো পরটা আর মাংস।শেষে দই।
এভাবে অনেক পর্ব পার হয়ে এখন বেহেনরাতের খাওয়া ভুল।ইস্তার ভুল।আর ও অনেককিছু। এখন পয়েন্ট ধরে কথা বলে সবাই। রোজায় ও বাকবিতন্ডা বন্ধ নেই।আগে রোজা রেখে ঝগড়া বিবাদ,অন্যের অনিষ্ট করার চিন্তা ছিল খুব বিরল।।বরং অনেক দিনের পুরনো বিবাদ মীমাংসা হতো রোজায়, ঈদের সময়।এখন রোজায় এবং ঈদের সময় ও চলে প্রতিহিংসা। ক্ষুদ্রের আর ও বেশি ক্ষুদ্রতার প্রকাশ।
অথচ জসীমউদ্দিন সে সময়ে লিখেছেন,
`গইজদ্দিন গরু ছেড়ে দিয়ে খাওয়াছে মোর ধান,
ইচ্ছে করিছে থাপপড় মারি,ধরি তার দুটো কান।
তবু তার পাশে বসিয়া নামাজ পড়িতে আজিকে হবে,
আল্লার ঘরে ছোটো খাটো কথা কে বা মনে রাখে কবে।
---
মাহে রমজান আসিয়াছে রোজার চাঁদের ন্যায়,
কাইজা ফেসাদ সব ভুলে যাব আজি তার মহিমায়। `
বিএস/