• ঢাকা শুক্রবার
    ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ঈদের দিনের করণীয় ও বর্জনীয় কাজ জেনে নিন

প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২৩, ০২:২৪ পিএম

ঈদের দিনের করণীয় ও বর্জনীয় কাজ জেনে নিন

ছবি: সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

ঈদ অর্থ আনন্দ উৎসব, যা বারবার ফিরে আসে। ফিতর অর্থ রোজা ভঙ্গ করা। ঈদের দিন প্রাতরাশ গ্রহণ করে এক মাস রোজা রাখার নিয়মকে ভাঙা হয় বিধায় এই ঈদকে ঈদুল ফিতর বলে। ঈদ কেবল আনন্দ উৎসবের নাম নয়, বরং ইবাদত-বন্দেগির দ্বারা মহান আল্লাহর অনুগ্রহ, ক্ষমা ও সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম।

ঈদুল ফিতরের দিন আনন্দ উৎসব উদ্‌যাপন করা হয় এই কারণে যে, দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা করে আমরা অফুরান কল্যাণ অর্জনের সুযোগ লাভ করেছি। ঈদুল ফিতরের এই আনন্দ উৎসবও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। আর ইবাদতময় এই আনন্দ উৎসব থেকে আরও কল্যাণ লাভের জন্য প্রয়োজন হলো মহান আল্লাহর বিধান এবং রাসুল (সা.) এর সুন্নতের অনুসরণ। রাসুল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম যেভাবে ঈদের প্রস্তুতি নিয়েছেন এবং যেভাবে ঈদ উদ্‌যাপন করেছেন আমাদের জন্যও করণীয় হলো সেভাবে প্রস্তুতি নেয়া এবং উদ্‌যাপন করা।

ঈদুল ফিতরের দিন পালনীয় কাজ—
ঈদের নামাজের আগে গোসল করা সুন্নত। গোসল করলে শরীর সতেজ থাকে এবং মন ফুরফুরে হয়। এতে ঈদের দিনের আমল এবং আনন্দ উদ্‌যাপনে বাড়তি ভালো লাগা কাজ করে।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন গোসল করতেন। (বোখারি: ১/১৩০)

নতুন ও ভালো পোশাক-পরিচ্ছদ ছাড়া উৎসব হয় নিরানন্দের। ঈদ নিরানন্দের উৎসব নয়। ঈদ মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ আনন্দের উৎসব। তাই ঈদকে যথার্থ আনন্দময় করতে নতুন ও ভালো পোশাক পরিধান করতে হবে। ঈদের দিন সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ও পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করা সুন্নত। হজরত জাবের (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) এর এমন একটি জুব্বা ছিল, যা তিনি দুই ঈদ ও জুমার দিন পরতেন।’ (সহীহ ইবনে খুযাইমা ১৭৬৫)

রাসুল (সা.) সুগন্ধি খুব পছন্দ করতেন। তিনি নিজে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন এবং সাহাবায়ে কেরামকেও সুগন্ধি ব্যবহারের উপদেশ দিতেন। ঈদের দিনের সুন্নতগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সুগন্ধি ব্যবহার করা। (মুসতাদরাকে হাকিম: ৭৫৬০, দররুল মুখতার: ২/১৬৮)

ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার আগে সামান্য কিছু পানাহার করা সুন্নত। রমজান শেষে শাওয়ালের প্রথম দিনে পালিত ঈদকে বলা হয় ‘ঈদুল ফিতর’ বা রোজা ভাঙার উৎসব। এক মাসের নিয়মিত রোজাকে ভাঙা হয় ঈদের দিন। রোজা ভাঙা বা ইফতার করা হয় খাবার গ্রহণের মাধ্যমে। যেহেতু মুহূর্তটি ‘রোজা ভাঙার উৎসব’, আর মিষ্টান্ন ছাড়া উৎসব কেমন যেন পরিপূর্ণ হয় না, তাই ঈদুল ফিতরের সকালে মিষ্টি জাতীয় খাবার গ্রহণ করা স্বয়ং এই উৎসবের দাবি।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিন ঈদের নামাজের আগে খেতেন না। (মুসনাদে আহমদ: ১৪২২)

সদকাতুল ফিতর আদায় করা সামর্থ্যবানদের জন্য ওয়াজিব। ঈদুল ফিতরের নামাজে যাওয়ার আগে সদকাতুল ফিতর আদায় করা উত্তম। রাসুল (সা.) ঈদের নামাজ আদায়ের আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। নামাজের পর তা প্রদান করলে সাধারণ দানের অন্তর্ভুক্ত হবে।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগে সদকা আদায় করল, তাই গ্রহণযোগ্য সদকাতুল ফিতর। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নামাজের পর তা আদায় করল, তা সাধারণ দানের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হলো। (আবু দাউদ: ১৬০৯)

কোনো প্রয়োজন বা তাড়াহুড়া না থাকলে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নত।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) হেঁটে ঈদগাহে গমন করতেন এবং পায়ে হেঁটে ঈদগাহ থেকে প্রত্যাগমন করতেন। (তিরমিজি: ১২৯৫)

ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার সময় নিচু স্বরে এই তাকবির বলা সুন্নত— ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ (ফতোয়া দারুল উলুম দেওবন্দ: ২৬০১৬)

খোলা মাঠে ঈদের নামাজ পড়া সুন্নত। শরয়ী ওজর ব্যতীত ঈদের নামাজ মসজিদে আদায় করলে সুন্নতের খেলাফ হবে। (দুররুল মুখতার: ২/১৬৯)

ঈদগাহে যাতায়াতের রাস্তা পরিবর্তন করা সুন্নত। তাই ঈদগাহে এক রাস্তা দিয়ে গমন এবং ঈদগাহ থেকে অন্য রাস্তা দিয়ে প্রত্যাগমন করা। হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ঈদের দিন ঈদগাহে আসা-যাওয়ার রাস্তা পরিবর্তন করতেন। (বুখারি: ৯৮৬)

ঈদের দিন একে অন্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে শুভেচ্ছা বিনিময় করা সুন্নত। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) এর সাহাবোয়ে কেরাম ঈদের দিন পরস্পর সাক্ষাৎ হলে বলতেন ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’ অর্থাৎ আল্লাহ আমার এবং আপনার যাবতীয় ভালো কাজ কবুল করুন। (ফাতহুল কাদির: ২/৫১৭)

ঈদের নামাজের আগে কিংবা পরে ঈদগাহে নফল নামাজ পড়া করা মাকরুহ। ঈদের নামাজের পর ঈদগাহ থেকে বাড়ি ফিরে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়া সুন্নত।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) ঈদের নামাজের আগে কোনো নামাজ পড়তেন না। তবে নামাজের পর ঘরে ফিরে করে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন। (ইবনে মাজাহ: ১২৯৩)

ঈদের নামাজের পর পরস্পরে মুসাফাহা ও মুয়ানাকা (কোলাকুলি) করার বিষয়ে অনেকে জানতে চান, বিষয়টি শরিয়ত সম্মত কি না?

মুসাফাহা ও মুয়ানাকার শরয়ী বিধান হলো, কারও সঙ্গে প্রথম বা দীর্ঘদিন পর সাক্ষাৎ হলে কিংবা কাউকে বিদায় দেয়ার সময় মুসাফাহা ও মুয়ানাকা করা সুন্নত। এসব ক্ষেত্রে মুসাফাহা ও মুয়ানাকা করা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। ঈদের নামাজের পর দেখা যায় লোকজন একে অপরের সঙ্গে মুসাফাহা ও মুয়ানাকা করে। অথচ একে অপরের সঙ্গে আগেই দেখা সাক্ষাৎ হয়ে গেছে। তাই প্রচলিত নিয়মানুযায়ী ঈদের নামাজের পর যে মুসাফাহা ও মুয়ানাকা করা হয়, যদি তা সুন্নত ও শরিয়তসম্মত মনে করে করা হয় তাহলে বিদাআত ও মাকরুহ হবে। কেননা ঈদের নামাজের পর রাসুল (সা.) থেকে এমন কাজ প্রমাণিত নয়। তবে কারও সঙ্গে যদি দীর্ঘদিন পর প্রথম সাক্ষাৎ হয় ঈদের নামাজের পর তাহলে মুসাফাহা ও মুয়ানাকা করা শরিয়তসম্মত হবে। (ফতোয়া শামি ৫/৩৩৬, আহসানুল ফতোয়া ২/৩৫৪, ফতোয়া দারুল উলুম দেওবন্দ: ৪৭৪৫১)

কোলাকুলি করার শরয়ী পদ্ধতি হলো, পরস্পরের ডান গলা মিলিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে একবার কোলাকুলি করা এবং ‘আল্লাহুম্মা জিদ মাহাব্বাতি লিল্লাহি ওয়া রাসুলিহি’ পড়া সুন্নত। তিনবার কোলাকুলি করা জরুরি নয়। (ফতোয়া মাহমুদিয়া: ২৮/২১১)

মুসলমানদের ঈদের আনন্দ উৎসব যেন অমুসলিমদের আনন্দ-উৎসব ও আমোদ-ফুর্তির মতো না হয়। মুমিন মুসলমানগণ তাদের ঈদ উদ্‌যাপনে আল্লাহর নাম ভুলবে না, শরিয়তের সীমা অতিক্রম করবে না, বিজাতির উৎসব ও আমোদ-প্রমোদের অনুসরণ করবে না এবং গোনাহে লিপ্ত হবে না।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো জাতির অনুকরণ, অনুসরণ ও সামঞ্জস্য বিধান করবে, সে ব্যক্তি তাদেরই অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। (আবু দাউদ: ৪০৩১)

আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহর প্রতি নিয়ামত হিসেবে ঈদ দান করেছেন। দ্বিতীয় হিজরিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম ঈদ পালন করেছেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনাতে আগমন করলেন তখন মদিনাবাসীদের দুটি দিবস ছিল, যে দিবসে তারা খেলাধুলা করত।

হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, এ দুদিনের কী তাৎপর্য আছে?

মদিনাবাসীগণ উত্তর দিলেন, আমরা জাহেলি যুগে এ দুই দিনে খেলাধুলা করতাম। তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তায়ালা এ দুই দিনের পরিবর্তে তোমাদের জন্য এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দুটো দিন দিয়েছেন। তা হলো- ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর। (আবু দাউদ: ১১৩৪)

শুধু খেলাধুলা, আমোদ-ফুর্তির জন্য যে দুটি দিন ছিল আল্লাহ তা পরিবর্তন করে এমন দুটি দিন দান করলেন যে দিনে আল্লাহর শোকরিয়া, তার জিকির, তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে শালীন আমোদ-ফুর্তি, সাজসজ্জা, খাওয়া-দাওয়া করা হবে।

ঈদের দিন বর্জনীয়—
ঈদের দিন এমন কোনো কাজ করা উচিত নয়, যা করতে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন।


ঈদের আনন্দ করতে গিয়ে অমুসলিমদের আদর্শ ও সংস্কৃতি মুসলমানদের জন্য গ্রহণ করা উচিত নয়।
ঈদের দিন আনন্দের নামে যে কোনো ধরনের অশ্লীল কাজ-কর্ম বর্জন করা মুমিন মুসলমানের জন্য আবশ্যক।


ঈদ উৎসব উদযাপনের নামে যে কোনো প্রকারের অশালীন খোলামেলা পোশাক পরা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।


ঈদের আনন্দের নামে নারী-পুরুষের বেশ বা পোশাক পরা এবং পুরুষ-নারীর বেশ বা পোশাক পরা নিষিদ্ধ।
ঈদের আনন্দের অজুহাতে ঈদের দিন বাদ্যযন্ত্র বাজানো, নাচানাচি করা, পটকা ফুটানো বা যে কোনো আতশবাজি সম্পূর্ণ বর্জন করা আবশ্যক।

ঈদের আনন্দের নামে নারীদের বেপর্দায় বাইরে বের হওয়া বর্জনীয় কাজ।
 

জেকেএস/

আর্কাইভ