প্রকাশিত: এপ্রিল ১৩, ২০২৩, ১২:৩৪ এএম
মাহে রমজানে শেষ দশকের মর্যাদা সবচেয়ে বেশি। নাজাতের এই দশকেই রয়েছে মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ রাত লাইলাতুল কদর বা শবে কদর। এটি কোরআনুল কারিম নাজিলের রাত। আবার শবে কদরের সম্মানে ‘সুরাতুল কদর’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সুরাও আছে পবিত্র কোরআনে। এ সুরায় বলা হয়েছে—‘লাইলাতুল কদরে কোরআন নাজিল হয়েছে, এটি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম এবং এ রাতে ফেরেশতারা আল্লাহর নির্দেশে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। এ রাতের ফজর পর্যন্ত প্রশান্তি বর্ষিত হয়।’ (দেখুন সুরা কদর: ১-৫)
এই মহান রাতে গুরুত্বের সঙ্গে নামাজ-দোয়া ও জিকির-আজকারসহ প্রত্যেকটি নেক আমলের সীমাহীন ফজিলত বর্ণিত হয়েছে হাদিসে। প্রিয়নবী (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় কদরের রাতে ইবাদতের মধ্যে রাত জাগবে, তার আগের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’ (সহিহ বুখারি: ৩৫), বিভিন্ন হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, ২৭ রমজানের রাতটি শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি হলেও শেষ দশকের প্রত্যেক বিজোড় রাতেই শবে কদরের সম্ভাবনা রয়েছে। মহানবী (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাতে লাইলাতুল কদর তালাশ করো।’ (বুখারি: ২০১৭)
আজ বুধবার ১২ এপ্রিল মাগরিবের আজান হলেই ২১ রমজানের রাত শুরু হবে। এটি বিজোড় রাত। সেই হিসেবে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইমাম তিরমিজি (রহ.) তার সুনানে লিখেছেন, ইমাম শাফেয়ি (রহ) ২১তম রাতকে কদরের রাত মনে করতেন। তার মতের পক্ষে দলিল হলো আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণিত হাদিস। তিনি বলেন, ‘আমরা নবী (স.)-এর সাথে রমজানের মধ্য দশকে ইতেকাফ করি। তিনি ২০ তারিখ সকালে বের হয়ে আমাদের সম্বোধন করে বলেন, ‘‘আমাকে কদরের রাত দেখানো হয়েছিলো; পরে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতে তার সন্ধান করো। আমি দেখতে পেয়েছি যে, আমি (ওই রাতে) কাদা-পানিতে সেজদা করছি।
অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসুলের সাথে ইতেকাফ করেছে, সে যেন ফিরে আসে (অর্থাৎ মসজিদ থেকে বের না হয়)।’’ আমরা সবাই ফিরে আসলাম। আমরা আকাশে হালকা মেঘ খণ্ডও দেখতে পাইনি। পরে এমনভাবে মেঘ দেখা দিলো ও জোরে বৃষ্টি হলো যে খেজুরের শাখায় তৈরি মসজিদের ছাদ হতে পানি ঝরতে লাগলো। সালাত শুরু হলে আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে কাদা-পানিতে সেজদা করতে দেখলাম। পরে তাঁর কপালে আমি কাদার চিহ্ন দেখতে পাই।’ (অর্থাৎ, নবীজির স্বপ্ন সত্য হয়েছে) (বুখারি: ২০১৬)
মুহাদ্দিসগণ অনেকেই এই হাদিস থেকে ব্যাখ্যা করেছেন যে, সেবছর কদর হয়েছিল ২১ তম রাতে। (মুফতি আমিমুল ইহসান (রাহ.) সংকলিত, ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) অনূদিত ফিকহুস সুনান গ্রন্থে (১/৪৮০) এই বিষয়টি টীকায় উল্লেখিত হয়েছে) আরেকদল আলেমের মতে, শবে কদর শেষ সাত রাতের কোনো এক রাতে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের পক্ষে দলিল হলো- ইবনু উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকে কদরের রাত অনুসন্ধান করো। তোমাদের কেউ যদি দুর্বল অথবা অপারগ হয়ে পড়ে, তবে সে যেন শেষ সাত রাতে অলসতা না করে।’ (মুসলিম: ২৬৫৫)
সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনু উনাইস (রা.) রমজানের ২৩তম রাতকে কদরের রাত মনে করতেন (মুসলিম: ২৬৬৫)। আলেমদের আরেকটি বড় জামাত বলেছেন, এটি রমজানের ২৭তম রাতে। এই মত দিয়েছেন উবাই ইবনু কাব (রা.), ইবনু আব্বাস (রা.), উমর (রা.), ইমাম আবু হানিফা (রহ)-সহ অনেকেই। এই মতের পক্ষে দলিল হলো, সাহাবি উবাই ইবনু কাব (রা.) কসম খেয়ে বলতেন, ২৭তম রাতটি লাইলাতুল কদর। (মুসলিম: ২৬৬৮)
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রাহ.) একটি বিশুদ্ধ হাদিসের আলোকে বলেছেন, যদি রমজান মাস ৩০ দিনে হয়, তবে শেষ দশকের জোড় রাতগুলোতেও কদর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর দলিল হলো—রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমরা (কদর) সন্ধান করো (শেষ দশকের) অবশিষ্ট (থাকা রাতগুলোর) নবম রাতে, অবশিষ্ট (থাকা রাতগুলোর) সপ্তম রাতে, অবশিষ্ট (থাকা রাতগুলোর) পঞ্চম রাতে, অবশিষ্ট (থাকা রাতগুলোর) তৃতীয় রাতে এবং অবশিষ্ট (থাকা রাতগুলোর) শেষ রাতে।’ (তিরমিজি: ৭৯৪)
এ হাদিসে আমরা দেখতে পাই যে, যদি রমজান মাস ৩০ দিনের হয়, তাহলে অবশিষ্ট নবম রাতটি হবে রমজানের ২২তম রাত, অবশিষ্ট সপ্তম রাতটি হবে ২৪তম রাত, অবশিষ্ট পঞ্চম রাতটি হবে ২৬তম রাত এবং অবশিষ্ট তৃতীয় রাতটি হবে ২৮তম রাত। আর এভাবেই সাহাবি আবু সাঈদ খুদরি (রা.) কদরের রাত সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছেন। (এই গণনা শেষদিক থেকে করা হয়েছে। হাসান বাসরি (রহ) থেকেও এভাবে গণনার পক্ষে দলিল রয়েছে)
অন্যদিকে, যদি রমজান মাস ২৯ দিনের হয়, তাহলে উক্ত হাদিস অনুযায়ী কদরের রাত পড়বে শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে। অতএব, ঈমানদারদের উচিত, রমজানের শেষ দশকের প্রতিটি রাতেই লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করা। (মাজমুউ ফতোয়া: ২৫/২৮৪-২৮৫)
গত শতাব্দির প্রখ্যাত ফকিহ ও মুহাদ্দিস শায়খ ইবনু উসাইমিন (রাহ.)-ও বলেছেন, জোড়-বেজোড় যেকোনো রাতেই কদর হতে পারে। (শারহুল মুমতি: ৬/৪৯২)
এজন্য আমরা হাদিসে দেখি, নবীজি শুধু বেজোড় রাতে নয়, শেষ দশকের প্রতিটি রাতেই ইবাদত করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) (রমজানের) শেষ দশকে যে পরিমাণ আমল করতেন, অন্যকোনো সময়ে সে পরিমাণ আমল করতেন না।’ (মুসলিম: ২৬৭৮) তবে, সন্দেহ নেই যে, কদরের রাত বিজোড় রাতে হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আবার বিজোড় রাতগুলোর মধ্যে ২৭ রমজান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এ প্রসঙ্গে অনেক হাদিস এসেছে। তবে আমরা প্রত্যেক বিজোড় রাতকে গুরুত্ব দেবো, আবার জোড় রাতগুলোতে অবহেলা করবো না।
বিএস/