প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৩, ০৩:৪০ পিএম
কেউ অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে, কেউ খানিক পর পর প্রতিবাদের ভঙ্গিতে কিছু বলার চেষ্টা করছে, কেউ হাসছে হিহি করে, কেউ কাঁদছে কোনো কারণ ছাড়াই, কেউ বা আবার একেবারেই নির্বাক। গত শনিবার দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বহির্বিভাগে ১১৯, ১২০ ও ১২১ নম্বর কক্ষের সামনে এমন দৃশ্য দেখা যায়। সংখ্যায় তারা ২৫ থেকে ৩০ জন। সবাই যে মানসিক সমস্যায় ভুগছে, তাদের হাবভাবে তা স্পষ্ট। স্বজন বা অভিভাবকরা তাদের চিকিৎসক দেখাতে নিয়ে এসেছে।
ঢাকার নবাবগঞ্জের বাসিন্দা রোজিনা জানান, সেলিমের বয়স এখন ২৬ বছর। ১৬ বছরে বয়সে সেলিমের এমন কিছু লক্ষণ দেখা যায়, যা মানসিক সমস্যার প্রাথমিক উপসর্গ; কিন্তু ওই সময় তাঁরা এটা বুঝতে পারেননি। সেলিম তখন মাঝেমধ্যে স্থির বসে থাকতেন, কারো সঙ্গে কথা বলতেন না। এরপর যখন-তখন খেপে যেতে লাগলেন। ক্ষিপ্ত থাকা অবস্থায় কাউকে সামনে পেলে গালাগাল ও মারধর করতেন। সারা রাত কথা বলতেন একা একা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সেলিমের এই রোগটিকে বলা সিজোফ্রেনিয়া। সিজোফ্রেনিয়া উপসর্গ সাধারণত ১৩ থেকে ১৪ বছর বয়সে প্রকাশ পেতে থাকে। এ রোগের লক্ষণগুলো হলো ডিলিউশন বা হ্যালুসিনেশন। অর্থাৎ ভুল ধারণা, অবাস্তব চিন্তা-ভাবনা, অকারণ সন্দেহ, বিভ্রান্তি, বিড়ম্বনা।
রোজিনা বলেন, ‘সেলিমের যখন মানসিক রোগ প্রকাশ পেতে থাকে, তখন আমরা তার মানসিক সমস্যা বুঝতে না পেরে কবিরাজ দিয়ে ঝাড়ফুঁক করিয়েছি; কিন্তু ১০ বছরেও কোনো লাভ হয়নি। বরং ধোঁকাবাজ কবিরাজের পাল্লায় পড়ে জমি বিক্রি করে টাকা-পয়সা শেষ করেছি।’
রোজিনা বলেন, ‘এক বছর ধরে এই হাসপাতালে ভাইয়ের চিকিৎসা করাচ্ছি। ভর্তি করাতে পারি না। যখনই আসি, বলা হয় বিছানা খালি নাই। আর তিন-চারজন মানুষ ছাড়া তো আসা যায় না। এতে খরচাও হয় অনেক।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকে। আর ২০০ রোগী গড়ে ভর্তি থাকে। তাদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া রোগীই বেশি।’
বিধান রঞ্জন রায় বলেন, যেসব মানসিক রোগীকে বাড়িতে সামলানো যায় না, তাদেরই মূলত হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়; কিন্তু আমরা সবাইকে ভর্তি করাতে পারি না। বেশির ভাগ সময় বিছানা ফাঁকা থাকে না।
তিনি বলেন, মানসিক রোগী যত দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আসবে, তার উন্নতি তত দ্রুত হবে। চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হলে তা হবে দীর্ঘমেয়াদি। চিকিৎসায় সময় বেশি লাগলে অনেক অভিভাবক ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। খরচ চালাতে না পেরে মাঝপথে থেমে যান অনেকে।
বিশেষজ্ঞরা মূলত মানসিক রোগকে দুই ভাগে করে থাকেন। এর মধ্যে গুরুতর হলো সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিস-অর্ডার, ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশতা, আলঝেইমারস। আর সাধারণ মানসিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, শুচিবায়ু, ফোবিয়া বা ভীতি ও বিষণ্নতায় ভোগা। বাইপোলার ডিস-অর্ডার সমস্যার ক্ষেত্রে রোগী কখনো খুব আনন্দে আবার কখনো খুব বিষণ্ন থাকে। ডায়াবেটিসের মতো বাইপোলার ডিস-অর্ডার দীর্ঘমেয়াদি মানসিক সমস্যা। ওষুধ বা চিকিৎসার মাধ্যমে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তবে রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয় না।
২৫ শতাংশ সিজোফ্রেনিয়া ভালো হয় : মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. আহসানুল হাবিব বলেন, সিজোফ্রেনিয়া বেশির ভাগ সময় ক্রনিক হয়ে যায়। তবে ২৫ শতাংশ সিজোফ্রেনিয়া এক পর্যায়ে সুস্থ হয়ে ওঠে। ৫০ শতাংশ সিজোফ্রেনিয়ার রোগী ওষুধ খেলে স্বাভাবিক থাকে, ঠিকমতো ওষুধ না খেলে আবার অসুস্থ হয়ে যায়। বাকি ২৫ শতাংশ কখনো ভালো হয় না। তখন এরা সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
আহসানুল হাবিব বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে দেখা যায়, রোগীর যত্নে পরিবারে মানুষ থাকে না। কারণ যিনি রোগীর যত্ন নেন, তিনি তাঁর নিজের কাজগুলো করতে পারেন না। তখন রাষ্ট্র তাঁদের দায়িত্ব নেয়। হোটেলের মতো থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। সেখানে রোগীরা ওষুধ খায়, শুশ্রূষা চলে। একই সঙ্গে বিভিন্ন কাজ শেখানো হয়, যাতে তারা সমাজে স্বাভাবিকভাবে থাকার উপযোগী হয়ে ওঠে। এতে অনেকে সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে কাজ শুরু করতে পারে। আমাদের দেশে এমন কোনো ইনস্টিটিউট বা প্রতিষ্ঠান নেই। যারা মানসিক রোগী, তাদের আমরা সঠিক সেবা দিতে পারি না নানা সংকটে।’
অপ্রতুল চিকিৎসাব্যবস্থা : বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিবেদন ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কর্মকৌশল পরিকল্পনা ২০২০-৩০-এ বলা হয়েছে, দেশের প্রায় তিন কোটি মানুষ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এর মধ্যে ৯২ থেকে ৯৪ শতাংশ চিকিৎসার বাইরে থেকে যায়। এসব রোগীর মধ্যে ১৮.৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং ১৩ শতাংশ শিশু। মানসিক রোগীদের মধ্যে ১০ থেকে ১৪ শতাংশের ভেতর আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কর্মকৌশল পরিকল্পনার তথ্য অনুযায়ী, ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী জনসংখ্যার মধ্যে মানসিক রোগের সামগ্রিক প্রবণতা ১৮.৭ শতাংশ। ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে মানসিক রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি, যা ২০.২ শতাংশ। ৫০ থেকে ৫৯ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রবণতা ১৯.৪ শতাংশ, ৩০ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রবণতা ১৬.৫ শতাংশ, ৪০ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ১৫ শতাংশ এবং ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে মানসিক রোগের প্রবণতা ১১ শতাংশ।
জাতীয় মানসিক ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, দেশে যারা মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়, তাদের একটি অংশ আক্রান্ত হয় বায়োলজিক্যাল এবং জেনেটিক কারণে। কিন্তু বড় একটি অংশ আক্রান্ত হয় পারিবারিক ও সামাজিক কারণে। নানা ধরনের মানসিক চাপ, দারিদ্র্য, সামাজিক ও পারিবারিক অসংগতি এর অন্যতম কারণ।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, মানসিক রোগের ক্ষেত্রে এখনো সঠিক সময়ে চিকিৎসা দেওয়ায় ঘাটতি রয়েছে। সরকারিভাবে ২০০ শয্যার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ৫০০ শয্যার পাবনা মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতাল, ৪০ শয্যার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া সামরিক ও সশস্ত্র বাহিনী পরিচালিত হাসপাতালেও এই সেবার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে এখনো দিবাযত্ন চিকিৎসা-সুবিধা প্রতিষ্ঠা হয়নি। সব মিলিয়ে এক লাখ মানুষের জন্য শয্যাসংখ্যা ০.৪ শতাংশ।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কর্মকৌশল পরিকল্পনা ২০২০-৩০-এ আরো বলা হয়, সরকারের মোট স্বাস্থ্য বাজেট থেকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য বরাদ্দ ০.৫০ শতাংশ। মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালগুলোতে ব্যয়ের পরিমাণ মোট মানসিক স্বাস্থ্য বাজেটের ৩৫.৫৯ শতাংশ। সে অনুযায়ী, প্রতিজন মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় ২.৪ টাকা। সারা দেশে মোট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন ৩৫০ জন আর মনোবিজ্ঞানী ৫০০ জন। এ ছাড়া অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ ও ল্যাংগুয়েজ থেরাপিস্ট, সাইকিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্কার্স খুব অপ্রতুল। অর্থাৎ এক লাখ মানুষের জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ০.১৩ জন, ০.১২ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ০.৮৭ স্বাস্থ্যবিষয়ক সেবিকা ও ১.১৭ মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী।
ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রতি চারজনে একজন কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছে। এর মধ্যে বছরে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করছে। আর মোট মানসিক রোগীর ৯৪ শতাংশ চিকিৎসার বাইরে থাকে। যাদের বেশির ভাগ প্রথম দিকে ঝাড়ফুঁকের মতো অপচিকিৎসা নিয়ে থাকে। তিনি বলেন, মানসিক চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি হয়। এতে অনেকের চিকিৎসা ব্যয় বহন করার সামর্থ্য থাকে না। ফলে অনেক রোগী ওষুধ বন্ধ করে দেয়, ফলোআপ করে না। এ ছাড়া আমাদের মানসিক চিকিৎসাব্যবস্থা খুব অপ্রতুল। যারা চিকিৎসা নিতে আসে, তারাও সেখানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাচ্ছে না।