প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৩, ০৬:৪৮ পিএম
ইসলামে নামাজ, রোজার মতো পর্দার বিধানও ফরজ। ফরজ বিধানগুলো নারী-পুরুষ সবার জন্য সমান। ক্ষেত্র বিশেষে কিছু পার্থক্য রয়েছে। অন্য অনেক বিধান মানার প্রতি গুরুত্ব থাকলেও পর্দার প্রতি অবহেলা থাকে অনেকেরই। নারীদের এ বিধান পালনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হলেও পুরুষদের জন্যও পর্দা পালন ও এর বিধান মানার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা অনেকটাই ঢাকা পড়ে যায় অন্য আলোচনার ভিড়ে।
পুরুষদেরও পর্দার বিধান রয়েছে শুনলে অনেকেই হয়তো কিছুটা অবাকও হতে পারেন। অথচ পবিত্র কোরআনে পর্দার বিধান সম্পর্কিত আয়াতটিতে প্রথমে পুরুষদের আলোচনা করা হয়েছে।
বর্ণিত হয়েছে, মহান আল্লাহ বলেন, ‘(হে নবী!) আপনি ঈমানদার পুরুষদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য উত্তম পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয়ই তারা যা করে আল্লাহ এ ব্যাপারে অবগত। আর ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং যৌনাঙ্গের হেফাজত করে।’ (সুরা নুর : ৩০)।
এই আয়াতের শুরুতেই ঈমানদার পুরুষদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে। ইচ্ছাকৃত দৃষ্টিপাত কিংবা তাকানোই হচ্ছে যৌন প্রবৃত্তির সূচনা এবং এর শেষ পরিণতি পাপ ও ফেতনাসহ জিনা-ব্যভিচার, যার পরিণাম ভয়ঙ্কর।
পর্দার বিধান নারী-পুরুষ সবার জন্য সমান হলেও দুজনের পর্দার ব্যবহারিক পার্থক্য রয়েছে। নারী বাইরে বেরুলে বোরকা-চাদর ইত্যাদির মাধ্যমে তার শারীরিক অবস্থা ঢেকে রেখে পর্দা করবে। আর পুরুষ কাপড়ের মাধ্যমে নিজেকে আড়াল করে পর্দা করবে না। তার পর্দা হবে নিজেকে সংযত রাখা, চোখের হেফাজত করার মাধ্যমে। পুরুষ পরনারীর দিকে তাকাবে না, হুটহাট নারীর ঘরে ঢুকবে না।
ঘরের মানুষের অনুপস্থিতিতে একজন মুসলিম নারীর সঙ্গে একজন পুরুষ কীভাবে যোগাযোগ করবেন, এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা হলো- ‘আর তোমরা যখন তাদের কাছে কোনো জিনিস পেতে চাইবে, তখন তা পর্দার আড়ালে বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের কাছে চাইবে। বস্তুত এ নীতি তোমাদের ও তাদের অন্তরের পবিত্রতা রক্ষার পক্ষে অধিকতর উপযোগী।’ (সুরা আহজাব: ৫৩)
এছাড়া পবিত্র কোরআনে পুরুষ ও নারীর জন্য ১৪ জনকে মাহরাম বলা হয়েছে, যাদের সঙ্গে সরাসরি দেখা-সাক্ষাত ও কথা বলা জায়েজ। তাই পুরুষের জন্য উচিত এই নারীদের বাইরে অন্য কারো সঙ্গে কথা না বলা। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে,
‘তোমাদের প্রতি হারাম করা হয়েছে তোমাদের মা এবং মেয়ে, বোন, ফুফু, খালা, ভাইঝি, ভাগিনী, দুধ মা, দুধ বোন, শ্বাশুড়ি, তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যার সঙ্গে সঙ্গম হয়েছ তার পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত মেয়ে যারা তোমাদের তত্ত্বাবধানে আছে, কিন্তু যদি তাদের সঙ্গে তোমরা সহবাস না করে থাক, তবে (তাদের বদলে তাদের মেয়েদেরকে বিয়ে করলে) তোমাদের প্রতি গুনাহ নেই এবং (তোমাদের প্রতি হারাম করা হয়েছে) তোমাদের ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রী এবং এক সঙ্গে দু’ বোনকে (বিবাহ বন্ধনে) রাখা, পূর্বে যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, দয়ালু।’ -(সুরা নিসা : আয়াত ২৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো বেগানা নারীর সৌন্দর্যের প্রতি যৌন লালসা নিয়ে তাকাবে, কিয়ামতের দিন তার চোখে সিসা ঢেলে দেওয়া হবে।’ (ফাতহুল কাদির)।
হজরত বুরায়দা ইবনে আল-হাসিব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) হযরত আলীকে (রা.) বলেন, ‘হে আলী! দৃষ্টির পর দৃষ্টি ফেলো না। অনিচ্ছাকৃত যে দৃষ্টি পড়ে এর জন্য তুমি ক্ষমা পাবে। কিন্তু পরবর্তী দৃষ্টির জন্য ক্ষমা পাবে না।’ (আবু দাউদ : ১/২৯২)।
তিনি পুরুষদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘পথের হকগুলোর একটি অন্যতম হক হলো, দৃষ্টিকে সংযত রাখা।’ (বুখারি : ৬২২৯)।
তিনি আরও বলেছেন, ‘নারীদের সঙ্গে নির্জনে অবস্থান করো না। ওই সত্তার শপথ- যার হাতে আমার প্রাণ, যখনই কোনো পুরুষ কোনো নারীর সঙ্গে একান্তে থাকে, তখনই তাদের মধ্যে তৃতীয় হিসেবে শয়তান এসে অনুপ্রবেশ করে এবং তার জাল বিস্তার করতে থাকে। কোনো বেগানা নারীর কাঁধের সঙ্গে ধাক্কা লাগার চেয়ে পচা দুর্গন্ধযুক্ত নর্দমায় জড়ানো শূকরের সঙ্গে ধাক্কা লাগাও সহনীয়।’ (নাইলুল আওতার : ৬/১২০)।
সৃষ্টিগত কারণে পোশাকের পর্দার ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি ইসলাম কঠোর নির্দেশ দিয়েছে বটে। কিন্তু দৃষ্টিগত ও হৃদয়গত পর্দায় পুরুষদেরকে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে।
পর্দার বিধান পালনের ক্ষেত্রে পুরুষের কিছু বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা উচিত। এখান তুলে ধরা হলো-
১. পুরুষের নাভীর ওপর থেকে হাঁটুর নিচে এবং টাকনুর ওপর পর্যন্ত ঢাকতে হবে। পুরুষের হাটুর ওপরে এবং টাকনুর নিচে কাপড় পরা কবিরা গুনাহ ।
২. এমন পোশাক পরিধান করবে, যা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আবেদনময় হবে না এবং বিকৃত চিন্তার জন্ম দিবেনা।
৩. পোশাক এমন পাতলা হওয়া যাবেনা যাতে কাপড় পরা সত্বেও ওপর দিয়ে ভেতরের চামড়া নজরে আসে। কারণ এমন কাপড় পরা না পরা একই কথা।
৪. পোশাক হতে হবে ঢিলেঢালা এবং মার্জিত। এমন আঁট-সাঁট (টাইটফিট) হওয়া যাবেনা যাতে দেহের উঁচু-নিচু গঠন বোঝা যায় ।
৫. পোশাকটি যেন কোনো অবিশ্বাসী/কাফেরদের অনুকৃত না হয়। প্রিয় নবীজী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন (পোশাকে, চাল-চলনে অনুকরণ) করবে, সে তাদেরই দলভুক্ত।’ (আবূ দাউদ, মিশকাত: ৪৩৪৭)
৬. পোশাকটি যেন বিপরীত লিঙ্গের পোশাকের অনুরূপ না হয়। এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন-সেই সমস্ত নারীদেরকে অভিশাপ দিয়েছেন, যারা পুরুষদের বেশ ধারণ করে এবং সেই সমস্ত পুরুষদেরকেও অভিশাপ দিয়েছেন, যারা নারীদের বেশ ধারণ করে। (আবূ দাউদ: ৪০৯৭, ইবনে মাজাহ: ১৯০৪)
৭. পোশাক যেন জাঁকজমকপূর্ণ প্রসিদ্ধিজনক না হয়। কারণ, এমন ধরনের পোশাক পরলে সাধারণত পরিধানকারীর মনে অহংকারের সৃষ্টি হয়। তাই মহানবী (সা.) বলেন- ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে প্রসিদ্ধিজনক পোশাক পরবে, আল্লাহ্ তাকে কিয়ামতের দিন লাঞ্ছনার পোশাক পরাবেন। (আহমাদ, আবূ দাউদ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত: ৪৩৪৬)