প্রকাশিত: জানুয়ারি ৩০, ২০২৫, ১১:১৬ এএম
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে দৃশ্যমান হতে শুরু করছে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ। নির্বাচনে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে আগাম প্রস্তুতি হিসাবে ডান-বাম ও ইসলামি দলগুলোকে কাছে টানতে তৎপর দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপি। অন্য দলগুলোর ভোট একই বাক্সে নিতে রীতিমতো টানাটানি শুরু করেছে বিএনপি ও জামায়াত। তবে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর জোট না মঞ্চ, নাকি সমঝোতা-সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে দলগুলো। সংশ্লিষ্ট দলগুলোর শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য।
তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল ও বিগত দিনে ওই সরকারে যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোট বা সমাঝোতার কোনো চিন্তা নেই বিএনপি ও জামায়াতের। এ দুদল ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্পর্ক বাড়িয়েছে। এদিকে ছাত্র নেতৃত্বের সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির রাজনৈতিক দল ফেব্রুয়ারিতে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। নতুন এই দল নিয়েও রাজনৈতিক মাঠে নানা আলোচনা চলছে। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে জামায়াতের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। আবার বিএনপির সঙ্গেও ছাত্রনেতাদের যোগাযোগ রয়েছে এবং তা আরও বাড়াতে চায় বলে জানা গেছে। বিএনপি ও জামায়াতের একাধিক নেতা জানান, আগামী নির্বাচনে জোট গঠন নিয়েই তারা বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। জোট বা মঞ্চ যে নামেই তা গঠন হতে পারে। সেক্ষেত্রে জামায়াত চেষ্টা করছে একটি আসনে ইসলামি দলগুলোর একজন প্রার্থী থাকবে। আবার বিএনপির তৎপরতা আছে, ২০১৮ সালের স্টাইলে মিত্রদের ‘ধানের শীষ’ প্রতীক নিয়ে ভোটে অংশ নেওয়া। অর্থাৎ দুদলই ভোটের মাঠে ‘এক বাক্স’ থাকার বিষয়ে বেশ তৎপর। তবে রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই জানিয়ে দলগুলোর নেতারা বলেন, এখন যে যার মতো তৎপরতা চালাচ্ছেন। নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা হলে অনেক চিত্রই পালটে যাবে। এমনও হতে পারে-বিএনপি-জামায়াত-ছাত্রনেতাদের নতুন দলসহ মিত্ররা একসঙ্গে থাকবে। সবকিছু নির্ভর করবে আওয়ামী লীগের ভোটে আসা না আসার ওপর।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিতে একটি নতুন সমীকরণ হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে পারবে কিনা তা নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়েছে। সেক্ষেত্রে বিএনপি দেশের এখন অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল। এই দলটি ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে আগামীতে সরকার গঠন করতে পারলে ‘জাতীয় সরকার’ হবে। সেখানে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনসহ বিগত আন্দোলনে যেসব দল রাজপথে ছিল, তাদের সবাইকে এই জাতীয় সরকারে নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো চাইবে বিএনপির সঙ্গে থাকতে। আবার জামায়াতে ইসলামীও মাঠে বেশ সক্রিয়। কিন্তু বিগত নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় জামায়াতের ভোট কিন্তু তেমন বাড়েনি। তবে বর্তমান বাস্তবতায় দলটির ভোট হয়তো বেড়েছে। মতাদর্শিক দূরত্বের কারণে অন্য ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জোট বা সমঝোতা হবে কিনা তাও একটা বিষয়। তবে ছাত্রদের নতুন দল হলে এবং তাদের সঙ্গে যদি জামায়াত জোট করতে পারে তাহলে ভোট বাড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, ন্যূনতম সংস্কার শেষে অতি দ্রুত একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে বাংলাদেশের মানুষকে সংকট থেকে মুক্ত করতে হবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই বিএনপির সুসম্পর্ক রয়েছে। আগামী নির্বাচন একক নাকি জোটগতভাবে-এটা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। নির্বাচন এলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হয়, তারপর সিদ্ধান্ত হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি মনে করি সামনে নির্বাচনকে ঘিরে দুই ধরনের মেরুকরণ থাকবে। একটি বিএনপির নেতৃত্বে মধ্যপন্থি যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে; আর অনেকটা ধর্মভিত্তিক দল নয় সেগুলো একদিকে থাকবে। অপরদিকে ধর্মভিত্তিক দল যেগুলো আছে, সেগুলো একদিকে হওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় একদিকে হতে পারাটা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম কাজ। কারণ বিরোধটা যদি ধর্মকে কেন্দ্র করে হয়, সেটাকে মেটানোও খুব কঠিন। তারপরও সেই চেষ্টা চলছে। শেষ পর্যন্ত এমন কিছু হতে পারে, বিএনপির ইতোমধ্যে মিত্র অনেক দল আছে, এসব দল মিলে জোট হতে পারে। আরেকটা জামায়াতে ইসলামী, বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক দল এবং সামনে নতুন একটি দল মিলিয়ে আরেকটা মেরুতে থাকতে পারে।’
বিগত নির্বাচনের পরিসংখ্যানে ভোটের হিসাব বলছে, পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভোটের হার ছিল ৩০.৮১। জামায়াতের ১২.১৩ শতাংশ। জাকের পার্টি ১.২২, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ১.১৯, বাংলাদেশে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের ১.৮১। ওই নির্বাচনে মোট ৭৫টি দল অংশ নিলেও ছোট দলগুলো ১ শতাংশের নিচে ভোট পায়। সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভোটের হার ছিল ৩৩.৬১। জামায়াতের ৮.৬১ শতাংশ। ইসলামী ঐক্যজোট ১.০৯ শতাংশ ভোট পায়। এই নির্বাচনে মোট ৮১টি দল অংশ নিলেও ছোট সব দল ১ শতাংশের নিচে ভোট পায়। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভোটের হার ছিল ৪০.৯৭। জামায়াতের ৪.২৭ শতাংশ। এ নির্বাচনে ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ৭.২৫, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (নাজিউর) ১.১২ শতাংশ ভোট পায়। এই নির্বাচনে মোট ৫৪টি দল অংশ নিলেও শুধু ইসলামী ঐক্যজোট দশমিক ৬৮ শতাংশ ভোট পেলেও ছোট সব দল পেয়েছে আরও কম। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভোটের হার ছিল ৩১.০৫। জামায়াতের ৪.৭ শতাংশ। এই নির্বাচনে ছোট রাজনৈতিক দলগুলো কেউই ১ শতাংশও ভোট পায়নি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি, জামায়াতসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বর্জন করে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াত অংশ নেয়। এ নির্বাচনে জামায়াতের নিবন্ধন না থাকায় ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে অংশ নেয়। কিন্তু আগের রাতে ভোট হওয়াসহ ব্যাপক কারচুপি হলে এই নির্বাচনও প্রত্যাখ্যান করে বিএনপিসহ মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনও বর্জন করে বিএনপি-জামায়াতসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল।
সূত্রমতে, ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ফোরামেও ভোটের হিসাবসহ নানা বিশ্লেষণ কষতে শুরু করেছে। কোন দলের সঙ্গে জোট বা সম্পর্ক রাখলে আগামী নির্বাচনে সুবিধা হবে সে আলোচনা চলছে দলগুলোর মধ্যে। অন্তত দশটি বাম-ডান ও ইসলামি দলের শীর্ষ নেতারা জানান, সামনে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হবে। তাদের ধারণা বিশেষ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলে রাজনৈতিক চিত্র পালটে যাবে। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যদি নির্বাচনি মাঠে ভার্চুয়ালি বক্তব্যও দেন, এখনকার চিত্র আর তখনকার চিত্র এক থাকবে না। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সামনের দিনগুলোকে মূল্যায়ন করতে চান না তারা। কারণ সামনে বিএনপির এই শীর্ষ দুই নেতা দেশের রাজনীতিতে এখন অনেক জনপ্রিয়-এটি মাথায় রাখতে চান। তাই এখনই নয়, নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে চান।
ডান-বাম ও ইসলামি দলগুলোকে সঙ্গে রাখতে চায় বিএনপি : ২০ দলীয় জোট ভেঙে যাওয়ার পরও মিত্রদের নিয়েই আন্দোলন করেছে বিএনপি। এখনো ৬ দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, এলডিপি, ১১ দলীয় জাতীয়তাবাদী জোট, চার দলীয় গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি (পার্থ), এনডিএম, লেবার পার্টিসহ নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত অন্তত ৫২ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক অব্যাহত রয়েছে বিএনপির। নানা ইস্যুতে বিভিন্ন সময় তাদের সঙ্গে বৈঠকও করছে দলটি। পাশাপাশি গণঅধিকার পরিষদ, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদার করছে। ইতোমধ্যে মিত্র দলের ৬ শীর্ষ নেতার সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি আসনে স্থানীয় নেতাকর্মীকে চিঠি দিয়ে সহায়তার নির্দেশ দিয়েছে বিএনপি। এরকম আরও কয়েকজনকে মৌখিকভাবে নিজ আসনে কাজ করার জন্য বলা হয়েছে। ২২ জানুয়ারি খেলাফত মজলিসও বিএনপির আমন্ত্রণে গুলশান কার্যালয়ে যায়। দ্রুত নির্বাচনসহ সাত দাবিতে ঐকমত্য পোষণ করে। শিগগিরই মাওলানা মামুনুল হকের খেলাফতকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা রয়েছে। সম্পর্ক উন্নয়নে সোমবার ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পিরের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, বিএনপি চায় সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ থাকুক। সেই কাজটিই তারা করছেন। নির্বাচনে জোট গঠনের বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সু-সম্পর্ক বজায় রেখেই চলতে চায়। নির্বাচন অনুষ্ঠানের তফশিল হলে জোট করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে মিত্রদের ধানের শীষ প্রতীকেই নির্বাচন করার বিষয়টি আসতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানান, আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, বিএনপি ও ছাত্রনেতারা এমনকি নির্বাচনকেন্দ্রিক বৃহত্তর সমঝোতার বিষয়েও অনাগ্রহী নন (এর ধরন ও ফর্মুলা আলোচনা সাপেক্ষ)। এ বিষয়টিও বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আলোচনা চলছে। সেক্ষেত্রে বিএনপির সঙ্গে মিত্রদের তালিকায় ছাত্রদের নতুন দলও আসতে পারে। নতুন চমক দিয়েই এবারের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে।