• ঢাকা শুক্রবার
    ০৮ নভেম্বর, ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

সরকারকে ‘বড় ধাক্কা’ দিতে নতুন কৌশলে বিএনপি

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৩, ২০২৩, ১১:৩১ এএম

সরকারকে ‘বড় ধাক্কা’ দিতে নতুন কৌশলে বিএনপি

ছবি: সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

চলমান আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ পথে রেখেই সরকারকে ‘বড় ধাক্কা’ দিতে চায় বিএনপি। এজন্য কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক-এ তিন দিক থেকে নীরবে সরকারকে কাবু করার কৌশল নিয়েছে দলটি। এর অংশ হিসাবে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে। যেখানে ভোট বর্জনসহ পাঁচটি দফা দিয়ে তা পালনের আহ্বান জানানো হয়। জনসমর্থন বাড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে দেশব্যাপী ব্যাপক গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করছে তারা। দেশের বাইরেও এ নিয়ে ব্যাপক প্রচারণার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। থাকবে রাজপথে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিও। ভোটের দিনসহ পাঁচ দিন ‘গণকারফিউ’ দেওয়ার চিন্তাও রয়েছে। এসব কর্মসূচিতে মিত্রদের সমর্থন পাওয়ায় আন্দোলন সফলে আশা দেখছে দলটি। একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।

নেতারা আরও জানান, অনেক পর্যালোচনা করে নীতিনির্ধারকদের পরামর্শে ও আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। যে কারণে এই আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ ছিল না। পাঁচটি দফা পালনের যে আহ্বান জানানো হয়েছে তা বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। তবে তা বাস্তবায়নে দেশের পাশাপাশি বিদেশেও ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এতটুকু বলা যায়, অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে।

তারা আরও জানান, ২৮ অক্টোবরের পর এই প্রথমবারের মতো গণসংযোগকে কেন্দ্র করে প্রায় সব সাংগঠনিক জেলায় নেতাকর্মীরা মাঠে নামতে পেরেছেন। গত দুই দিনে ৬০ লাখের মতো লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। যুগপথে থাকা সমমনাদের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীরও তৎপরতা বেড়েছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর সব সাংগঠনিক থানায় জামায়াত লিফলেট বিতরণ করেছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাও নিজ নিজ এলাকায় থেকে গণসংযোগে অংশ নিচ্ছেন। যে কারণে নেতাকর্মীদেরও আগের চেয়ে উজ্জীবিত দেখা গেছে। যা আগামী দিনের কর্মসূচিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

সূত্রমতে, আগামীকাল রোববার সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ কর্মসূচি রয়েছে। একদিন বিরতি দিয়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত হরতাল অথবা অবরোধ ও গণসংযোগের কর্মসূচি পালনের কথা রয়েছে। এরপর আন্দোলনের ধরন আবারও পরিবর্তনের কথা ভাবছে বিএনপি। যার মধ্যে ৩ জানুয়ারি থেকে ভোটের দিন ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘গণকারফিউ’ দেওয়ার কথা আলোচনায় রয়েছে। অসহযোগের মধ্যেই ‘গণকারফিউ’ দেওয়া হতে পারে। যেখানে জনগণকে বাসা থেকে বের না হওয়া, ব্যক্তিগত গাড়ি ও গণপরিবহণ বন্ধ এবং সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধের আহ্বান জানানো হতে পারে। নতুন বছরের শুরুতে এই কর্মসূচির ডাক আসতে পারে। পাশাপাশি সে সময় সর্বশক্তি নিয়ে বিএনপিসহ সমমনা দল ও জামায়াতে ইসলামী মাঠে থাকবে বলে ইতোমধ্যে আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন বর্জন করা অন্যান্য রাজনৈতিক দলও পৃথকভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান সিটি নিউজ ঢাকাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার চলমান আন্দোলনে অসহযোগের ঘোষণা নতুন করে এই সত্য প্রতিষ্ঠা করেছে যে, বিএনপি একটি উদারপন্থি রাজনৈতিক দল। যারা ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে এবং সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় আস্থাশীল হয়ে তাদের প্রতিবাদ ও আন্দোলন পরিচালনা করে থাকে। লাখ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই স্বাধীন বাংলাদেশকে এই বাকশালী সরকার দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক গভীর অমানিশার অন্ধকারে নিমজ্জিত করে দিয়েছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে দেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনা। এবং সেই উদ্দেশ্যেই বিএনপি অসহযোগের মন্ত্রে সরকারকে দীক্ষিত করে দেশের আঠারো কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার প্রয়াস নিয়েছে। সরকারকে সংঘাতের পথ থেকে বেরিয়ে এসে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ উন্মুক্ত করতে দেশবাসীর প্রতি এই আবেদন সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে বিএনপি বিশ্বাস করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমেই কেবল এ দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসতে পারে। যা অর্জন করার উদ্দেশ্যে বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মী আজ রাজপথে নেমেছে। বিএনপির জন্য নয়, কোনো ব্যক্তির জন্য নয়, বরং এ দেশের সব মানুষের মৌলিক ভোটের অধিকার তথা সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রাম অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের রাজপথের আন্দোলন চলতেই থাকবে।’

বিএনপির বিরুদ্ধে ’৯৬ সালে অসহযোগের মধ্যেই হরতাল, ঘেরাও ও অবরোধের মতো কর্মসূচি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো ওই কর্মসূচি পালন করে। ২৭ বছর পর এবার বিএনপি ও জামায়াত সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরই পুনর্বহালের দাবিতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একই কর্মসূচি দিয়েছে। সরকারকে কোনো ধরনের সহযোগিতা না করতে বিএনপি বুধবার এ আন্দোলনের ডাক দেয়। প্রশাসন, দেশবাসী ও দলীয় নেতাকর্মীদের ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে বিরত থাকা, সরকারকে কর, খাজনা, ইউটিলিটি বিল স্থগিত রাখা, ব্যাংকে টাকা জমা না রাখা, রাজনৈতিক মামলায় নেতাকর্মীদের আদালতে হাজিরা দেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে দলটি।

বিএনপি মনে করে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এ অবস্থায় বাংলাদেশের এবারের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক দেখতে চেয়েছে গণতান্ত্রিক বিশ্ব। বিএনপি, বাম ও ইসলামপন্থি অন্তত ৬৩ দল নির্বাচন বর্জন করেছে। ফলে এবারের নির্বাচনও দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে কিনা, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন আছে। এটি সরকারকে আরও বেশি কূটনৈতিক চাপে ফেলবে। পাশাপাশি দেশে অর্থনৈতিক সংকটও রয়েছে। এরপরও বিরোধী নেতাকর্মী ও সমর্থক যারা প্রবাসে থাকে তারা যদি অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ রাখে, তাহলে চলমান ডলার সংকট আরও বাড়বে। দেশের অভ্যন্তরে দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের কিছু অংশও যদি ট্যাক্স এবং ইউটিলিটি বিল দেওয়া থেকে বিরত থাকেন, তাহলে অর্থনৈতিকভাবে সরকারের ওপর চাপ আরও বাড়বে।

দলটির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৩৮ হাজারের বেশি মামলায় প্রায় ৫০ লাখ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসব নেতাকর্মীও যদি আদালতে হাজিরা দিতে না যান, তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হবে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আন্দোলন ও নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করবে, নাকি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করবে। দুই কাজ একসঙ্গে করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হবে না। তদুপরি বর্তমানে বিএনপির ২৩ হাজারেরও বেশি নেতাকর্মী কারাগারে। সেখানে এখন বন্দিসংখ্যা ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ। এ অবস্থায় আরও নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে সরকার কোথায় রাখবে? সব মিলিয়ে বিএনপির অসহযোগ আন্দোলন সরকারকে নতুন করে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে ফেলবে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম বলেন, ‘সরকারের প্রতিবন্ধকতা ও জুলুম নির্যাতন সত্ত্বেও জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সরকার জনগণের মতামতকে তোয়াক্কা না করে প্রহসনের নির্বাচনের যে আয়োজন করেছে, জনগণ তা কোনো অবস্থাতেই মেনে নেবে না।’

যদিও বিএনপি ও সমমনাদের একটি অংশ এ-ও মনে করেন, বাস্তবতার আলোকে বর্তমান পরিস্থিতিতে কর, খাজনা, ইউটিলিটি বিল প্রদান বন্ধ, আদালতে মামলার হাজিরা না দেওয়া, ব্যাংকে টাকা না রাখার আহ্বান বাস্তবায়ন করা হয়তো কঠিন। প্রতীকী অর্থেই সরকারকে নানাভাবে ‘অসহযোগিতা’ করার পরিকল্পনা থেকেই এ কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। এতে সরকারের ওপর যেমন চাপ তৈরি হবে, তেমনি জনগণও যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে চেষ্টা করবে। মানুষ সচেতন হলে অনেকভাবে সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগিতামূলক ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করেন তারা।

 

জেকেএস/

আর্কাইভ