• ঢাকা শুক্রবার
    ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

একদফায় অনড় বিএনপি

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৬, ২০২৩, ০৪:৫৩ পিএম

একদফায় অনড় বিএনপি

ছবি: সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শর্তহীন সংলাপের প্রস্তাব উপেক্ষা করে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করায় কিছুটা বিচলিত বিএনপি। তবে এমন পরিস্থিতিতেও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে অনড় দলটি। রাজপথে কঠোর আন্দোলনের মধ্য দিয়েই দাবি আদায় করতে চায় বিএনপির হাইকমান্ড। কয়েক দিন ধরে ভার্চুয়াল মাধ্যমে চলা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিরিজ বৈঠকে একতরফা তপশিল ঘোষণার বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তেও অনড় রয়েছে দলটি।

এদিকে তপশিলকে একতরফা আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। তপশিল সত্ত্বেও প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। শিগগির অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন হবে—এমন আশাবাদ তুলে ধরে সারা দেশের নেতাকর্মীদের হতাশ না হয়ে মাঠে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নির্বাচনমুখী নেতাদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। কেন্দ্র ও তৃণমূলের যেসব নেতা নির্বাচনে যেতে পারেন বলে দলে শঙ্কা রয়েছে, হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে পৃথকভাবে কথা বলা হচ্ছে।

বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতে শর্তহীন সংলাপ বসার আহ্বান জানিয়ে বড় তিন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। এর দুদিন আগে দেশে বর্তমানে সুষ্ঠু নির্বাচন ও তপশিল ঘোষণার পরিবেশ নেই দাবি করে তপশিল ঘোষণার প্রক্রিয়া দুই সপ্তাহ পেছানো এবং দলের শীর্ষ নেতাদের জামিনে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে কূটনীতিকদের মাধ্যমে সরকারকে বার্তা দিয়েছিল বিএনপি। এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপির কোনো কোনো নেতার ধারণা ছিল, ডোনাল্ড লুর ওই চিঠি এবং নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে বিএনপির দুই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো তপশিল ঘোষণা পিছিয়ে দেওয়া হতে পারে। একই সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হবে; কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের এই আশা পূরণ হওয়ার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। সরকার তার অবস্থানে অনড়। এরই মধ্যে শর্তহীন সংলাপের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে ক্ষমতাসীন দল। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল বুধবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘সংলাপের চিন্তা আগে তাদের ছিল, এখন সেই সময় চলে গেছে। সংলাপের সময় পার হয়ে গেছে।’

এমন পরিস্থিতিতে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। একদফার আন্দোলনকে আরও বেগবান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। আন্দোলনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করেই নির্বাচনে যেতে চান তারা। বিএনপির পক্ষ থেকে তৃণমূলে এবং যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের এরই মধ্যে এই বার্তা দেওয়া হয়েছে।

গতকাল নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তপশিলকে একতরফা আখ্যা দিয়ে এর প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ করেছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। তপশিল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, আমরা এই একতরফা তপশিল প্রত্যাখ্যান করছি। একতরফা নির্বাচনের তথাকথিত তপশিল জনগণ মানে না। এই নীলনকশার নির্বাচনের তপশিলে বাংলাদেশের মাটিতে কোনো নির্বাচন হবে না। তিনি আরও বলেন, জনগণের চলমান অগ্নিগর্ভ আন্দোলন আরো তীব্র, আরো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে এবং চলমান আন্দোলনে অতি দ্রুতই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটবে।

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, নির্বাচন কমিশন যে পরিস্থিতিতে তপশিল ঘোষণা করেছে, তাতে এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, তারা সরকারের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটিয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি কোনো কর্ণপাত না করেই তপশিল ঘোষণা প্রমাণ করে যে, এই সরকার একদলীয় নির্বাচনে বিরোধী দলকে স্টিম রোল করার জন্য নির্বাচন করছে। সংলাপের সম্ভাবনা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তপশিল ঘোষণার পর নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তনের একাধিক উদাহরণ আমরা দেখেছি। এমনকি তপশিল ঘোষণার পর একটি নির্বাচন সম্পূর্ণ বাতিলেরও উদাহরণ দেখেছি। স্পষ্টতই বাংলাদেশে রাজনীতি এবং আসন্ন নির্বাচন উভয়ই এখনো সম্পূর্ণ তরল অবস্থায় রয়েছে। সময়ই বলে দেবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র কোন দিকে যাচ্ছে।

গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশে সংঘর্ষের ঘটনার পর একদফা দাবিতে গত দুই সপ্তাহে চার দফায় দেশব্যাপী নয় দিন অবরোধ এবং এক দিন হরতাল পালন করেছে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। পঞ্চম দফায় গতকাল বুধবার সকাল থেকে দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি শুরু হয়েছে, যা আগামীকাল শুক্রবার ভোর ৬টায় শেষ হবে। ‘একতরফা’ তপশিল ঘোষণার প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার পূর্বঘোষিত অবরোধের পরিবর্তে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিএনপি, যা যুগপৎ শরিকদের জানিয়েও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে হরতালের কর্মসূচি থেকে সরে এসে অবরোধ বহাল রাখা হয়।

জানা গেছে, পঞ্চম দফার অবরোধ শেষে ‘একতরফা’ তপশিল ঘোষণার প্রতিবাদে শুক্র ও শনিবার বাদ দিয়ে আগামী সপ্তাহে রবি ও সোমবার হরতালের কর্মসূচি আসতে পারে। সেটা টানা ৪৮ ঘণ্টা অথবা রোববার সকাল-সন্ধ্যা এবং সোমবার সকাল-সন্ধ্যা হতে পারে। আজ বৃহস্পতিবারের মধ্যে নতুন এই কর্মসূচি চূড়ান্ত ও ঘোষণা করা হবে।

এদিকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) অভিমুখে ঘেরাওয়ের কর্মসূচি থেকে বিএনপি ও শরিকরা আপাতত সরে এসেছে বলে জানা গেছে। তারা বলছেন, নির্বাচন কমিশন সরকারের অনুগত হওয়ায় তপশিল ঘোষিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এখন ইসি ঘেরাওয়ের কর্মসূচি কার্যকারিতা হারিয়েছে। বিএনপির মনোযোগ এখন রাজপথে কার্যকর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করা, যাতে পুনঃতপশিল এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকার বাধ্য হয়। তপশিলের পর বিএনপির হাইকমান্ড এখন থেকে আন্দোলনের সব কর্মসূচি কঠোরভাবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের ব্যাপক তৎপরতা এবং সতর্ক দৃষ্টি থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো সমাধান না আসায় বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর মধ্যে হতাশা কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের সংলাপের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত এবং তপশিল ঘোষিত হওয়ায় নেতারাও কিছুটা বিচলিত। তাই তপশিলের প্রতিবাদে বিএনপি শক্ত কর্মসূচিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা আদৌ কতটা জোরালোভাবে পালিত হবে, আন্দোলনকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে কি না—তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন রয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় চলমান আন্দোলন যদি এবারও সফলতা না পায়, তাহলে দলটিকে আবারও ভোট বর্জনের পথেই হাঁটতে হতে পারে।

জানা গেছে, এমন পরিস্থিতিতে ভোট ঠেকাতে সর্বশেষ কর্মসূচি হিসেবে হরতাল-অবরোধের সঙ্গে অসহযোগ আন্দোলনেও যেতে পারে বিএনপি ও শরিকরা।

অবশ্য বিএনপির কেউ কেউ মনে করেন, এখনো তপশিল পরিবর্তনের সুযোগ আছে। বাংলাদেশে আগামীতে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিতে সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের চাপ অব্যাহত রয়েছে। নির্বাচন ইস্যুতে তাদের ব্যাপক তৎপরতা ও সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে। ফলে সরকার শেষ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাপ উপেক্ষা করতে পারবে না। ফলে তপশিল ও নির্বাচনের তারিখ ফের পেছাতে পারে।

ইসির ‘একতরফা’ তপশিল প্রত্যাখ্যান করে তা স্থগিত করার দাবি জানিয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র গণতন্ত্র মঞ্চ। এই জোটের অন্যতম নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক সিটি নিউজ ঢাকাকে বলেন, ‘একতরফা তপশিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন আগের দুটি নির্বাচনের মতো আরেকটি ব্যর্থ ও অকার্যকর নির্বাচনের দিকেই পা বাড়াল, যা দেশকে অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘাত-সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যাবে। সরকারের পাশাপাশি এর দায়দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপরও বর্তাবে। সে ধরনের অবস্থা এড়াতে ঘোষিত তপশিল স্থগিত করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন আন্দোলন আরও জোরদার করা হবে। পর্যায়ক্রমে মানুষকে যুক্ত করে আন্দোলন আরও উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হবে। যুগপতের শরিকরা যেমন রাজপথে আছেন, যুগপতের বাইরে থাকা অপরাপর বিরোধী দল ও জোটগুলোও রাজপথে আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছেন। সরকার এবং তার মিত্ররা ছাড়া বাদ বাকি সব বিরোধী দল বাস্তবে এই তপশিল প্রত্যাখ্যান করে রাজপথে অবস্থান নিচ্ছে। জনগণের এই আন্দোলন পর্যায়ক্রমে আরও গণঅভ্যুত্থান-গণবিস্ফোরণের পথ তৈরি করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। সরকারের চাপিয়ে দেওয়া নাশকতা-সহিংসতা এড়িয়ে যথাসম্ভব শান্তিপূর্ণ পথে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দাবি আদায় করব।’

 

সিটি নিউজ ঢাকার ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন

 

জেকেএস/

আর্কাইভ