প্রকাশিত: মে ১৮, ২০২৩, ০৩:০০ এএম
জাতীয় নির্বাচনের আগে দলীয় কোন্দল বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিএনপির জন্য। বেশ কয়েক বছর ধরেই নেতৃত্বের সংকটসহ নানান সমস্যায় জর্জরিত দলটি। অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সংঘাতের ঘটনা বেড়েই চলেছে। এরমধ্যে দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙে স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন নির্বাচন থেকে শুরু করে সম্প্রতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতৃত্বের সংকটের কারণে মূল ধারার রাজনীতি থেকে সরে যাচ্ছে বিএনপি। যদিও কেন্দ্রীয় নেতারা বিষয়টি মানতে নারাজ।
দেশের রাজনীতির প্রধান দুই পক্ষ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। তবে দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে রয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। ক্ষমতায় থাকার মধ্যে জন্ম নেয়া দলটি এর আগে এত দীর্ঘ সময় রাষ্ট্র পরিচালনার বাইরে ছিল না। অবশ্য বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল আওয়ামী লীগ এর আগে টানা প্রায় ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল।
তবে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় বিএনপি এখন বড় সংকটে রয়েছে। সহিংস, অহিংস কোনোভাবেই দাঁড়াতে পারছে না দলটি। দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধের জেরে হামলা-মামলার ঘটনাও বেড়েছে। এর মধ্যে সম্প্রতি দলটির মধ্যে বেশ কিছু হামলা-মামলা ও বহিষ্কারের ঘটনা আরও সংকটে ফেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
গত বছরের ডিসেম্বরে রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) নির্বাচনে কাউন্সিলর পদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার না করায় মহানগর যুবদলের সাধারণ সম্পাদক লিটন পারভেজকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। আর চলতি বছরের শুরুতেই জাতীয় সংসদ ও বিএনপি থেকে পদত্যাগ করা উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে দল থেকে বহিষ্কার ও এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে সুনির্দিষ্টভাবে জড়িত থাকায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির তিন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। একই অভিযোগে নরসিংদী জেলা ছাত্রদলের সিনিয়র সহসভাপতিসহ তিনজনকে বহিষ্কার করে ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটি।
এ ছাড়া দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সম্প্রতি বহিষ্কার হয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ। এরপর সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের তিন নেতা বহিষ্কার হন।
সম্প্রতি পাবনার সুজানগর উপজেলা ও পৌর বিএনপির কমিটি গঠন নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীরা তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। কিছুদিন ধরে কয়েক দফায় হামলা-মামলার ঘটনাও ঘটেছে। আর সবশেষ গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়া বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের ২৯ জন কাউন্সিলর প্রার্থীকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে দলটি। মঙ্গলবার (১৬ মে) দলের পক্ষ থেকে ওই প্রার্থীদের আলাদা করে বহিষ্কারের চিঠি পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স সিটি নিউজ ঢাকাকে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার ফাঁদ পেতেছে। আমাদের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে সরকার গাজীপুর সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর দাঁড় করিয়েছে। বিষয়টি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া মডেলের’ মতো। তারপরও আমরা চেষ্টা করেছি।’
কিন্তু কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত কেন মানছেন না নেতাকর্মীরা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কেন মানছেন না, সে বিষয়ে তো আমরা বলতে পারবো না। জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি নির্বাচন দিয়ে সরকার একটা ফাঁদ পেতেছে। কিন্তু সেই ফাঁদে আমরা পা দেবো না, সেটা আগেই আমরা বলেছি। তারপরও যারা দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করেছেন, তাদেরকে শোকজ করেছি। কেউ উত্তর দিয়েছেন, কেউ দেননি। যারা দিয়েছেন তাদের উত্তর সন্তোষজনক হয়নি। তাই তাদেরকে বহিষ্কার করেছি।’
বিষয়টি জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির রাজনীতিতে নেতিবাচক কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচন তো বহু দূর। তবুও বিষয়টি জাতীয় নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়বে না। তাছাড়া আমরা তো বলেছি যে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আমরা নির্বাচনে অংশ নেবো না।
এ বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন সিটি নিউজ ঢাকাকে বলেন, ‘ব্যক্তিস্বার্থে কেউ কেউ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। বিএনপি তো বলেছে যে নির্বাচনে অংশ নেবে না। তাই কোনো প্রার্থীও দেবে না। যেমন নারায়ণগঞ্জের তৈমুর আলম খন্দকারও করেছিলেন। এমন অনেকেই করেছেন। যারা করেছেন, তারা সবাই বহিষ্কার হয়েছেন। দলের সিদ্ধান্ত লঙঘন করলে তো বহিষ্কার করা হবে, সেটাই স্বাভাবিক।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা, সেটা নিয়ে ভাবছি না। আমরা দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করছি। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বললে দলের তো শৃঙ্খলা থাকতে হবে। শৃঙ্খলা না থাকলে তো দল চলে না। বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল। নিয়ম শৃঙ্খলা থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কেউ শৃঙ্খলা নষ্ট করতে চাইলে তাকেও বহিষ্কার করা হবে, সেটাই স্বাভাবিক।’
এ সংকট সমাধানের বিষেয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা পরে দেখা যাবে। আপাতত দলের শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করছি। এটা দলের সিদ্ধান্ত।’
তবে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় এই দুই নেতারই দাবি, ‘দলে নেতৃত্বের কোনো সংকট নেই।’ যদিও পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বিএনপির দায়িত্বশীল এক নেতা অভিযোগ করে বলেন, ‘নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধারে ইচ্ছাকৃতভাবে নেতাকর্মীদের নিষ্ক্রিয় করে রাখছেন শীর্ষ নেতারাই। দলে প্রভাব বিস্তারে নিজেদের অনুগতদের লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিরোধীদের পদ-পদবি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এতে বিরোধ বাড়ছে। বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ছে বিএনপি।’
‘এভাবে যদি নেতৃত্বের সংকট চলতে থাকে, তবে রাজনীতি থেকে বিএনপি দূরে সরে যাবে। ভবিষ্যতে তাদের জন্য এটা একটা বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছি’, যোগ করেন ইখতিয়ার উদ্দিন ভূঁইয়া।
তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি নির্বাচন সরকারের জন্য একটা পরীক্ষা। বিরোধী দলের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন কমিশনের জন্য বিষয়টি একটি চ্যালেঞ্চ। কারণ জাতীয় নির্বাচনে এ সিটি নির্বাচনের বড় একটা প্রভাব থাকবে। একটা রাজনৈতিক দলের কাজ হলো, নির্বাচনে অংশ নেয়া। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া। কিন্তু তারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। নির্বাচনে না গেলে তারা তো রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এতে করে বিএনপি পিছিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করি। ফলে তাদের জন্য একটা বড় সংকট তৈরি হতে পারে।’
জেকেএস/