ফারাজী আজমল হোসেন
ভারত যখন করোনার তীব্র ঢেউয়ে লণ্ডভণ্ড, তখন থেকেই সরকারিভাবে প্রস্তুতি শুরু বাংলাদেশের। চলতি বছরের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া এই লকডাউনে সবাইকে নিয়ম মেনে চলতে অনুরোধ জানানো হয়। বন্ধ করা হয় বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত। সরকারিভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য লকডাউন না বলে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার কথা মাথায় রেখে আরোপ করা হয় বিধিনিষেধ। সব সচেতন নাগরিকই ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যচর্চা করবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু তা হয়নি। চিত্র ছিল উল্টো। আর সে কারণেই এখন ভুগতে হচ্ছে দেশের মানুষকে। যখন লকডাউন কার্যকর ও কঠোর করে ভারতে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পথে, তখন বাংলাদেশে বেশ দ্রুত গতিতে বাড়ছে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা।
কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে যখন ৮ এপ্রিল সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে, তখন আমাদের কাছে বিষয়টি দাঁড়ায় ‘সকল দোকান খুলে ব্যবসা’। ছিল না কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানার ইচ্ছা। এ সময় পুলিশ বেশ কিছু দোকানপাট এবং সড়কে মাস্ক পরার জন্য কিছুটা কঠোরতা প্রদর্শন করলে সেটি নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাসাহাসি শুরু হয়। সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কঠোর আচরণের কোনো নির্দেশ না থাকায় প্রশাসন সরাসরি বিষয়গুলো নিয়ে হস্তক্ষেপ করেনি। মাঠে-ঘাটে, সড়কে, গণপরিবহনে, বড় থেকে ছোট শপিংমল এবং মার্কেটে মানুষ ঘুরে বেড়িয়েছে মাস্ক ছাড়া।
অথচ তার মাত্র এক সপ্তাহ আগে দেয়া লকডাউনের প্রভাবে মার্চের শেষে যখন রাজধানীর সব আইসিইউ করোনা রোগীতে ভর্তি ছিল, তা খালি হয়ে যায়। বেশ নিয়ন্ত্রণে আসে পরিস্থিতি। কিন্তু আন্দোলন শুরু হয় গণপরিবহন চালুর জন্য। বিষয়টি নিয়ে সড়কে নেমে আসেন পরিবহন শ্রমিক নেতারা। ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে সাবেক মন্ত্রীদের অনেকে আওয়াজ তোলেন গণপরিবহন চালুর জন্য। করোনা পরিস্থিতি তখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যাওয়ায় একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে গণপরিবহন চালু করে সরকার।
ঈদে শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ ছিল সরকারের। কিন্তু সব বিধিনিষেধ অমান্য করে সাঁতার কেটে গিয়েও ফেরিতে উঠেছে মানুষ। এমন ঘটনাও দেখেছে জাতি। ফেরিঘাটের চিত্র দেখে মনে হয়েছে, পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার আগে শেষবার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে সবাই!
ব্যক্তিগতভাবে একটি ঘটনা আমার মনে দাগ কেটেছে। এক ব্যক্তি তার ব্যাগ এবং সঙ্গে থাকা সব কিছু রেখে ছোট একটি ব্যাগ নিয়ে ফেরির দড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছেন। কিন্তু কেন? তিনি যদি মারা যেতেন, তাহলে এর জন্য দায়ী করা হতো কাকে? সরকারকে, ওই ব্যক্তিকে, নাকি তার পরিবারকে?
ঈদে যখন সবাই বাড়ি যায় তখনও সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা ছিল- দেশের সীমান্ত অঞ্চলগুলো থেকে যেন ঢাকায় কেউ না আসে। এ বিষয়ে সাধারণ একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। সরকার চাইলে আরও কঠোর হতে পারত। কিন্তু যেকোনো সচেতন নাগরিক মাত্রই বোঝা উচিত, অকারণে সরকারের কঠোরতা প্রদর্শন কোনো রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। এটি শুধু একনায়কতন্ত্রের ক্ষেত্রেই সম্ভব।
এপ্রিলের শুরুতে কার্যকরভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করার কারণে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলক কম থাকে। কিন্তু ঈদে সারা দেশে মানুষ ছড়িয়ে যাওয়া এবং তারপর আবারও ঢাকায় ফিরে আসার কয়েক সপ্তাহ পর থেকেই বাড়তে থাকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। শুরুতে বাড়ে আক্রান্তের সংখ্যা। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে মৃত্যু। সরকার এ সময় সচেতনতা তৈরির জন্য সময়ে সময়ে নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করে। জেলাপর্যায়ে লকডাউনসহ আরও বেশ কিছু ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করে। কিন্তু যেহেতু সরকার কঠোরতা প্রদর্শন করেনি, তাই সাধারণ মানুষও সচেতন হয়নি। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন যেন ব্যাহত না হয় সেজন্য শিথিল নির্দেশনা ও বিধিনিষেধগুলো প্রদান করে সরকার।
এর মধ্যে সীমান্তবর্তী জেলায় করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সেখানে প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। কিন্তু এ দেশের মানুষ সেই বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে রাতের আঁধারে ভ্যান বা রিকশা-জাতীয় ছোট ছোট পরিবহনে করে এই জেলাগুলোতে প্রবেশ করে এবং বের হয়ে আসে। বর্তমানে দেশের করোনার সার্বিক চিত্র এটিই প্রমাণ করে যে, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো থেকে ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে করোনা। আক্রান্তের হার মহামারির শুরুতে ঢাকায় ছিল বেশি। কিন্তু বর্তমানে আক্রান্তের হার বেশি প্রান্তিক জেলাগুলোতে। এর মূল কারণ সরকারি বিধিনিষেধের প্রতি গুরুত্ব না দেয়া।
বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের আরেকটি সমস্যা হলো, তারা বিশ্বাসই করতে চায় না করোনা বলতে কিছু রয়েছে! যখন ঢাকায় করোনায় মানুষ মারা যাচ্ছে, তখনও দেশের অনেক গ্রাম করোনা রোগীরই দেখা পায়নি। ফলে এখন গ্রাম থেকে করোনা ছড়িয়ে পড়ার পরও মানুষ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে মানছে না স্বাস্থ্যবিধি। গ্রামের চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় একসঙ্গে ১০-১৫টি মাস্কবিহীন মাথা দেখে সেখানে প্রবেশ না করে চলে গেলে আপনি হবেন সবার হাসির পাত্র। কেউ কেউ আবার নন্দলালের কবিতাও পড়ে শোনাতে পারে আপনাকে!
এই যখন দেশের সার্বিক করোনা সচেতনতা ও লকডাউন-বিধিনিষেধের চিত্র তখন বিগত সপ্তাহজুড়ে আমরা দৈনিক ১০০ জনের ওপরে মৃত্যু দেখছি। আক্রান্তের হার সার্বিকভাবে শতকরা ৩৫-৪০ ভাগ থেকে বেড়ে সেটি এখন প্রায় ৫০-৬০ ভাগ। কিছু কিছু জেলায় আক্রান্তের হার প্রায় ৯০ ভাগ। চলতি বছরের ১১ মে মৃত্যুর সংখ্যা ১২ হাজার ছাড়িয়ে যায়। আর গত শুক্রবার ১১ জুন দেশে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১৩ হাজার ছাড়িয়ে যায়। আর ২৬ জুন দেশে করোনায় মোট মৃত্যু ১৪ হাজার ছাড়িয়ে যায়। মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৯ লাখ ৪ হাজার ৫০০। কিছুতেই থামছে না আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল। বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে ভ্যাকসিন পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ের আগে। তাহলে কী করতে পারি আমরা? কী করতে পারে বাংলাদেশ সরকার?
ইতালিতে সম্প্রতি ঘোষণা দেয়া হয়েছে মাস্ক ছাড়াই চলতে পারবেন তারা। কিন্তু কিভাবে বিষয়টি সম্ভব হয়েছে? দেশের অধিকাংশ নাগরিককে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার পর এই ঘোষণা দেয় ইতালি। তার আগ পর্যন্ত দেশটিতে ছিল কঠোর লকডাউন। কেননা এই ভাইরাস মোকাবেলায় লকডাউন ও কোয়ারেন্টিন ছাড়া ভ্যাকসিনের আর কোনো বিকল্প জানা নেই কারও। যেহেতু বিশ্বের ৯০ ভাগ দেশের মতোই ভ্যাকসিনের জন্য আমরা এখনও অন্য দেশের ওপর নির্ভর করছি। তাই আমাদেরও পালন করতে হবে কঠোর লকডাউন।
মঙ্গলবার (২৯ জুন) জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশের ৮০ ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনা হবে।’ সরকারিভাবে সেই প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। হয়তো চলতি বছরে অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যেই সেটি সম্পন্ন হবে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত করোনা নিয়ন্ত্রণে আমরা কী করতে পারি? পৃথিবীর সব দেশে করোনা মোকাবেলায় কোন অস্ত্রটি ব্যবহার করা হচ্ছে? সত্যি কথা হচ্ছে, একমাত্র কঠোর লকডাউন ছাড়া সহসা করোনা নিয়ন্ত্রণের আর কোনো হাতিয়ার নেই আমাদের কাছে। যেহেতু এ দেশের মানুষকে মিষ্টিভাষায় অনুরোধ করলে লাভ হচ্ছে না, তাই প্রশাসনিক কঠোরতা প্রদর্শন ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। আগামীকাল ১ জুলাই থেকে সেটিই করতে যাচ্ছে সরকার।
সরকারের শেষ প্রজ্ঞাপন অনুসারে, বিধিনিষেধের নিয়ম পালনে বাধ্য করা হবে সবাইকে। অন্যথায় শাস্তি ও জরিমানার বিধান রাখা হচ্ছে। সব গণপরিবহনের পাশাপাশি বন্ধ থাকবে ব্যক্তিগত পরিবহনও। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া রাস্তায় বের হলে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হবে। কঠোরভাবে এই নিয়ম পালনের জন্য সহায়তা নেয়া হচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর। কিন্তু এখনও অনেকে সমালোচনা করছেন সরকারের এই ব্যবস্থাপনার। ‘কঠোর লকডাউন না দিলেও চলতো’- এমন একটা ভাব তাদের। অথচ সপ্তাহখানেক আগেও সরকার কেন কঠোর হচ্ছে না তার সমালোচনা করে টকশো ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কাঁপিয়েছেন তারা। তাদের কাছে জানতে চাই, আসলে কতজন মারা গেলে দেশের স্বার্থে কথা বলবেন?
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন