মির্জা রুমন
দেশে অনুষ্ঠিত পঞ্চম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়েছে। নির্বাচন-পরবর্তী ফলাফল অন্তত তাই বলছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলছেন- মূলত ‘তৃণমূলে ঐক্যের অভাব’ই এ ভরাডুবির কারণ। পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনের ফলাফলে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ৩৪৬টি ইউপিতে, অন্যদিকে নৌকা প্রার্থীরা জিতেছেন ৩৪১টি ইউপিতে। গত ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনে অংশ নেয় চারটি রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থীরা। তবে আগের ধাপগুলোর মতো পঞ্চম ধাপেও ইউপি নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপি।
পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর চেয়ে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বেশি জয়ী হয়েছেন। তবে এসব স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থী।
পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এই ভরাডুবির ফলে অনেক শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এই বিষয়ে কথাও বলতে রাজি হননি। নির্বাচনের এই ফলাফলের বিষয়ে কথা বলতে সিটি নিউজ ঢাকার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের সঙ্গে। কিন্তু এই ইউপি নির্বাচনের ফলাফলের বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এর আগের ধাপের ইউপি নির্বাচনের ফলাফলেও আওয়ামী লীগের ফলাফলে ভরাডুবি হয়। বিদায়ী বছরের ২৬ ডিসেম্বর সারা দেশে ৫৮টি জেলার মোট ৮৩৬টি ইউপিতে চতুর্থ ধাপের ইউপি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হয়। এই ধাপে ভোটের আগেই একক প্রার্থী হিসেবে ৪৮ ইউপির চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিনা ভোটে জয় নিশ্চিত করেন। ফলে ২৭ ডিসেম্বর ৮৩৬টির মধ্যে মোট ৭৯৬টি ইউনিয়নের ফল অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। এই নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, অন্তত ১২০টি ইউনিয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়ে তুলতে পারেননি আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। অন্তত ১১০টি ইউপিতে তৃতীয় বা চতুর্থ স্থান অধিকার করেছেন তারা। এমনকি নৌকার প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে ২৮টি ইউপিতে।
তবে গত বছরের ২১ জুন অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ফলাফল ছিল সন্তোষজনক। এরপর একই বছরের ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে দেশের ৮৩৫টি ইউনিয়ন পরিষদের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনেও বেশিরভাগ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা বিজয়ী হন। দেশে তৃতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় একই মাসের ২৮ তারিখে। মূলত এই তৃতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচন থেকেই আওয়ামী লীগের ভরাডুবি শুরু হয়। যা আরও বড় মাত্রা পায় চতুর্থ ধাপের ইউপি নির্বাচনে। এই নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের ভরাডুবি স্পষ্টত দৃশমান হয় সবার কাছে।
চতুর্থ ধাপের ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ৪৯ শতাংশ ইউপিতে। আর নৌকার প্রার্থীরা জিতেছেন ৪৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ ইউপিতে। প্রথম ধাপের নির্বাচনে যেটা ছিল ৭৬ শতাংশ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জিতেছিলেন যথাক্রমে ৫৬ ও ৫৩ শতাংশ ইউপিতে।
যে কোনো নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে ভাবা হয় ফরিদপুরকে। অথচ চতুর্থ ধাপের ইউপি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের ৯টিতে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা হেরেছেন। এর মধ্যে ৫টি ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থীরা জামানত খুইয়েছেন। ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপের নির্বাচনেও ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও চরভদ্রাসনের ১৫টি ইউনিয়নের ১৪টিতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছিলেন।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত অন্যান্য অনেক জেলাতেও দেখা গেছে নির্বাচনের ফল বিপর্যয়। ময়মনসিংহ, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জের মতো জায়গাতেও আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করা প্রার্থীদের করুণ অবস্থা দেখা গেছে এবারের চতুর্থ ধাপের ইউপি নির্বাচনে।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র সিটি নিউজ ঢাকাকে পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনে তাদের দলের এই ভরাডুবির কারণ হিসেবে বলেছেন, তৃণমূলে দলে ঐক্যের অভাব। সেই সঙ্গে তারা আরও মনে করেন, এবারের দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট সতর্ক ছিল না দল। অনেক ক্ষেত্রেই তৃণমূল থেকে পাঠানো নামকে উপেক্ষা করা হয়েছে। জনপ্রিয়তা যাচাই না করে স্থানীয় প্রভাবশালীদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, চতুর্থ ধাপের ইউপি নির্বাচনে সুনামগঞ্জ জেলার ২১টি ইউপির মধ্যে ৯টিতেই নৌকার প্রার্থীরা জামানত হারিয়েছেন। সেখানে মাত্র ৭টিতে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। ৬টিতে জয়ী হয়েছেন বিদ্রোহীরা।
যে কোনো নির্বাচনে শেরপুর জেলাকে ভাবা হয় আওয়ামী লীগের আরও একটি শক্ত ঘাঁটি হিসেবে। চতুর্থ ধাপের ইউপি নির্বাচনে ওই জেলার শ্রীবরদী উপজেলায় ৯টি ইউপির মধ্যে ৭টিতেই হেরেছে নৌকা। ওই ৭ ইউপির ৪টিতে স্বতন্ত্র ও ২টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা বিজয়ী হয়েছেন। চতুর্থ ধাপের ইউপি নির্বাচনে দিনাজপুরের ২১টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে নৌকা প্রতীকের অন্তত ৬ জন প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। রাঙামাটি জেলার ১০ ইউপির মধ্যে মাত্র ১টিতে জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ।
ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এমন ভরাডুবির কারণ কি? এমন প্রশ্ন ছিল আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমানের কাছে। এই প্রশ্নের জবাবে তিনি সিটি নিউজ ঢাকাকে বলেন, ‘দলীয়ভাবে আমাদের এইবারের ধাপের ইউপি নির্বাচনে ফলাফল খারাপ হয়েছে এটাতো স্বীকার করতেই হবে। এর দুর্বলতা কোথায় আছে, কি জন্য এমন ফলাফল হলো এই বিষয়গুলো আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
তবে দলটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ. ফ. ম. বাহাউদ্দিন নাছিম মনে করেন, পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ফলাফলে ভরাডুবি হয়নি। বরং এটা একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে।
এই পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনের ফলাফলকে দলীয়ভাবে কিভাবে দেখছেন, এমন প্রশ্ন ছিল আ. ফ. ম. বাহাউদ্দিন নাছিমের কাছে। এর উত্তরে তিনি সিটি নিউজ ঢাকাকে বলেন, ‘নির্বাচনে জনগণ অংশগ্রহণ করছে। এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বেশ ভালোই করেছে। আর নির্বাচনে যেসব বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভ করেছেন তারাও কিন্তু আওয়ামী লীগের লোক। নির্বাচনের সমগ্র ফলাফল আমাদের পক্ষেই আছে। জনমত আওয়ামী লীগের পক্ষেই আছে।’
রুমন/ডাকুয়া
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন