• ঢাকা বৃহস্পতিবার
    ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীর যৌক্তিকতা কতুটুকু?

প্রকাশিত: জুলাই ২৪, ২০২৩, ০২:১১ এএম

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীর যৌক্তিকতা কতুটুকু?

ডক্টর মোঃ মাহবুব আলম প্রদীপ

১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো অসহযোগ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সেই সময়ে ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার বাংলাদেশের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য হয়ছিলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিলো পরবর্তী জাতীয় সংসদের নির্বাচনগুলো অবাধ, সুষ্ঠ, ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। 

মূলত ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চরম অবিশ্বাসের কারণে অনন্য এই পদ্ধতিটি চালু করা হয়েছিল। তবে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বিএনপির এবং তাদের অন্যতম রাজনৈতিক সহযোগী যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামের অপরাজনীতির কারণে এই পদ্ধতিটি বাতিল করা হয়েছিলো। মূলত ২০১১ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একটি আদেশের ভিত্তিতে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিটি বাতিল করে। এরপর থেকে বিএনপি-জামায়াত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির পুর্নবহালের দাবীতে বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচন বয়কট করে। বিএনপি-জামায়তসহ অন্যান্য নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলো অবাধ, সুষ্ঠ, ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নামে দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলো। সামনে দ্বাদশ নির্বাচন আসন্ন। বিএনপি-জামায়াত আবারো দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরির পায়তারা করছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাকর্মীর বক্তব্য হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য এই পদ্ধতিটি বাতিল করেছে। বাস্তবতা হচ্ছে এই পদ্ধতিটিকে বিএনপি গলাটিপে হত্যা করেছে। এর পদ্ধতি বাতিলের জন্য রাজনৈতিকভাবে বিএনপি-জামায়াত দায়ী।  

আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, তারা ইচ্ছা করেই এই পদ্ধতিটি বাতিল করে দিয়েছে। আসলে কী তাই? একটি দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর আওয়ামী লীগ সরকার সুপ্রিম কোর্টের আদেশ বাস্তবায়ন করেছে মাত্র। সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী এম সলিমুল্লাহ, ২০০০ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানের ১৩ তম সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট পিটিশন করেন। পিটিশনে তিনি উল্লেখ করেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একটা অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রজাতন্ত্র একটি নির্বাচিত সরকার দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। এর রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৪ সালের ৪ অগাস্ট হাইকোর্ট ডিভিশন ১৩ তম সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা করেন। এর মধ্যে এম সলিমুল্লাহ ২০০৫ সালের জুন মাসে মৃত্যুবরণ করলে অন্য একজন আইনজীবি আব্দুল মান্নান খান হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। 

এই আপিলের পরিপেক্ষিতেই ২০১১ সালের ১০ মে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিলো। রায়ে বলা হয়েছিলো, "সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬ (১৯৯৬ সালের আইন ১) সম্ভাব্যভাবে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে কেননা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক"। সাথে সাথে সুপ্রিম কোর্ট পর্যবেক্ষণে বলেছিলো, ‘রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে এবং আদালত আরও পরামর্শ দিয়েছেন, জাতীয় সংসদ এ বযাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবে এবং এই ব্যবস্থার অধীনে যদি আরও দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিতে হয়ে তবে যেন সুপ্রিম কোর্টের অন্য কোনো বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত না করে। তাছাড়া পরবর্তী জাতীয় সাধারণ নির্বাচনগুলি দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। নতুন সংশোধনী অনুযায়ী, বর্তমান সংসদ ভেঙে দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন চৌদ্দ দলীয় জোট সুপ্রিম কোর্টের আদেশ আমলে নিয়ে জাতীয় সংসদে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়।

এই রায়ের পর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো থেকে অভিযোগ করা হয়েছিলো, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য এই পদ্ধতি বাতিল করেছে এবং আদালতের পর্যবেক্ষণ আমলে নেয়নি। এই অভিযোগের সত্যতা কতটুকু? প্রথমেই বলা হয়েছিলো যে, বিএনপি-জামায়াতের অপরাজনীতির কারণে দেশে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী এই পদ্ধতির সুযোগ নিয়ে অগণতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালনা করেছিলো।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নিজেদের লোককে বসানোর জন্য নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অবসরের বৃদ্ধি করে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলো। এর মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নিযুক্ত করেছিলেন। কে এম হাসানের অপসারণের দাবীতে দেশে রাজনৈতিক সংকট তৈরী হয় এবং এর জন্য প্রায় ৩০ জন মানুষ প্রাণ হারান। ফলশ্রুতিতে কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এমতাবস্থায়,  নীল নকশার নির্বাচন করার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ নিজেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নিযুক্ত করেন। সে সময় বিরোধী রাজনৈক দলগুলোর তীব্র বিরোধীতা স্বত্বেও বিএনপি-জামায়াত জোট দেশে নির্বাচনের আয়োজন করেছিলো। এর ফলে দেশে সেনাবাহিনী-সমর্থিত ফখরুদ্দিন সরকার অবৈধভাবে দুই বছর দেশ পরিচালনা করেছিলেন। দেশে এই রাজনৈতিক সংকট তৈরীর জন্য বিএনপি-জামায়াত জোট দায়ী। দেশে যেনো আর কোনো অপশক্তি তত্ত্বাবধায় সরকার ব্যবস্থার মতো অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভব না হয় সেজন্য আওয়ামী লীগ  নেতৃত্বাধীন চৌদ্দ দলীয় জোট আদালতের পর্যবেক্ষণ আমলে নেননি। বলাবাহুল্য যে, আদালতের পর্যবেক্ষণ আমলে নেয়া জাতীয় সংসদের জন্য জরুরী নয়।

এখানে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের কোনও প্রকার বরখেলাপ না হলেও অবাধ ও নিপরেক্ষ নির্বাচনের কথা বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে বিএনপি-জামায়াত জোট ২০১৪ সালের নির্বাচনের পূর্বে দেশে আগুন সন্ত্রাসের জন্ম দেয়। জ্বালাও পোড়াও করে শত শত মানুষকে পুড়িয়ে মারে। দেশে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। আন্দোলনের নামে দেশে জ্বালাও পড়াও এবং আগুন সন্ত্রাসের রাজনীতির ফলে দেশের মানুষ বিএনপি-জামায়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। 

বিএনপি-জামায়াত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দেশে অনির্দিষ্ট কালের জন্য হরতাল ও অবরোধ দিলে জনগণ তা প্রত্যাখান করে। উল্লেখ্য যে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পূর্বে আহূত হরতাল ও অবরোধ এখনও চলমান। এই অবস্থা থেকে বোঝা যায় যে, জনগণ অগণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচন চায় না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একটি অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি যা সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হলেও আমাদের জন্য সুখকর বিষয় নয়। তাছাড়া এই পদ্ধতিটি একটি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বাতিল হয়েছে। এবং এই বাতিল হওয়ার পেছনে য সকল রসদ দরকার ছিলো তার সবটুকু বিএনপি-জামায়াত যুগিয়েছে। সুতরাং এর দায় এই দুই দলকে নিতে হবে। এবং ভবিষ্যৎ এ দেশে যেনও কোনও অনির্বাচিত সরকার না আসতে পারে এবং দেশকে রাজনৈতিকভাবে মেধাশূণ্য না করতে পারে তার জন্যে সাংবিধানিকভাবেই আগামী নির্বাচন আয়োজন করা যুক্তিযুক্ত।

আর্কাইভ