প্রকাশিত: জুলাই ২২, ২০২৩, ০৫:৪০ এএম
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা নতুন কোনো বিষয় নয়। একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলতে এমন একটি অন্তর্বতীকালীন সরকারকে বোঝায় যার মেয়াদ খুবই সংক্ষিপ্ত। বিদ্যমান সরকারের কাঠামো, বিধি ও নীতিতে কোনও পরিবর্তন আনার এত বেশি কর্তৃত্ব নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর পাশাপাশি ইউরোপ এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশেও দেখা গেছে।
পৃথিবীর অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিদায়ী সরকারকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে তাদেরকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে পাওয়া যেতো, যেখানে বর্তমান সরকারই নির্বাচনের মাধ্যমে নবনির্বাচিতদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত দেশের শাসনভার পরিচালিত করতো। এমনকি কোনও একটি দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারলে নির্দলীয় কিংবা দলীয় সরকারের অধীনে গঠিত তত্ত্বাবধারক সরকারই দেশ পরিচালনা করতো। এর মধ্যে অন্যান্য দলগুলো জোট গঠনের মাধ্যমে সরকার পরিচালনার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতো। জোট সরকার গঠনের পূর্ব পর্যন্ত দেশগুলো একটি নির্দলীয় কিংবা টেকনোক্র্যাট সরকারের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করতো।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ১৯৪৫ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ২৪ টি টেকনোক্র্যাট সরকার ক্ষমতায় থেকে দেশ পরিচালনা করেছে।
তত্তাবধায়ক সরকারের এই অন্তর্বতীকালীন সময়ে সংশ্লিষ্ট দেশের রাজা কিংবা রাষ্ট্রপতি রাষ্টের দৈনন্দিন কাজ সম্পন্ন করার জন্য বিভিন্ন ব্যক্তিদের মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করতেন। এই মন্ত্রীরা শুধুমাত্র তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োজিত থাকতেন, অর্থাৎ তারা কোনও প্রকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না বা পুর্বের নীতিও পরিবর্তন করতে পারতেন না। তবে ২০১০ সালে বেলজিয়ামের নির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রায় ৫৯০ দিন ক্ষমতায় ছিলো।
ব্রিটেনেও রাজনৈতিক সংকট নিরসনে নির্দলীয় ও মহাজোট সরকার গঠনের মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠ, ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।
১৯৪০-১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানে বোমা হামলা, অবরোধ এবং প্রত্যাশিত আক্রমণের সংকট মোকাবেলায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন লিওনার্ড স্পেনসার চার্চিল তার নিজের কনজারভেটিভ পার্টি এবং বিরোধী দল লেবার পার্টিকে নিয়ে একটি জোট সরকার গঠন করা করেছিলেন যা অন্তর্বতীকালীন সরকারের মতো কাজ করেছিলো। এই জোট সরকার ১৯৪৫ সালের নির্বাচন পরিচালনা করেছিলো যেখানে প্রথমবারের মতো লেবার পার্টি কনজারভেটিভ পার্টিকে হারিয়ে নির্বাচনে জয় লাভ করেছিলো।
অস্ট্রেলিয়ায় ১৯৭৫ সালে বিরোধী দল যথাক্রমে লিবারেল এবং ন্যাশনাল পার্টি সিনেটকে অনেক মাস ধরে বাজেট অনুমোদন করা থেকে বিরত রাখে তখন গভর্নর-জেনারেল লিবারেল পার্টির নেতা নেতা ম্যালকম ফ্রেজারকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। পরবর্তীতে লেবার পার্টি ম্যালকম ফ্রেজারের বিরুদ্ধে সিনেটে অনাস্থা ভোটের প্রস্তাব দিলে ফ্রেজার গভর্নর-জেনারেলকে হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস এবং সিনেট ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের আহ্বান জানান। নির্বাচনকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রী ফ্রেজার কর্তৃক নিযুক্ত লিবারেল ও ন্যাশানাল পার্টির মন্ত্রীরা দেশ শাসন এবং নির্বাচন পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ফ্রেজারের লেবার পার্টি সরকার গঠন করে। এভাবে অস্ট্রেলিয়া নির্বাচনকালীন সমইয়ে বিভিন্ন সরকারের আচরণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক প্রথাটির বিকাশ সাধন করেছে।
উপরোক্ত দেশগুলো ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশেও তত্ত্বাবধারক সরকার ব্যবস্থার প্রচলন ও চর্চা ছিলো। ১৯৬০ সালে বার্মায় জেনারেল নে উইনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্বারা একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ফিজিতে ২০০০ সালে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। ১৯৯৩ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এছাড় নামিবিয়া (১৯৯৩), হাইতি (১৯৯৫) এবং মোজাম্বিকের (১৯৯৫) সাধারণ নির্বাচন জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৯৪ সালে সাধারণ নির্বাচনের সময় এক ধরণের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেছিলো।
১৯৯৬ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী জাতীয় সংসদের জন্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে বাংলাদেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার (এনসিজি) ব্যবস্থা চালু করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উৎপত্তি, চর্চা, ও বিলুপ্তির যৌক্তিকতা পরবর্তী লেখায় আলোচনা করবো।