প্রকাশিত: এপ্রিল ১১, ২০২৩, ০৩:৫৭ পিএম
০৯ এপ্রিল ২০২৩। মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে পাঠানো হলো আইনি নোটিশ! মাহমুদুল হাসান নামে জনৈক আইনজীবীর পাঠানো এই নোটিশে দাবি করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা অসাংবিধানিক, বেআইনি ও কৃত্রিম উদ্ভাবিত। লিগ্যাল নোটিশে বিবাদী করা হয়েছে—স্বরাষ্ট্র, ধর্ম এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিবকে। একই সঙ্গে ঢাকা জেলা প্রশাসক এবং চারুকলা অনুষদের ডিনকেও বিবাদী করা হয়েছে।
নোটিশে বলা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধ করা না হলে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করা হবে। ২০২২ সালে এই একই ব্যক্তি এমন নোটিশ পাঠিয়েছিলেন। প্রশ্ন আসতে পারে এগুলো পাত্তা দেওয়ার কী আছে? হয়তো পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই—আপাত দৃষ্টিতে এমনটাই মনে হয়। কিন্তু একটু গভীরে দেখলে বিষয়টা এত সহজ থাকে না।
এসব কদর্য চিন্তার লোক প্রথমে গুটিকয়েকই থাকে। ধীরে ধীরে তাদের বিস্তার বাড়ে। তারা সংখ্যায় বাড়ে। তারা দৈর্ঘ্যে বাড়ে। তারা প্রস্থে বাড়ে। তারা গোকুলে বাড়ে। সুতরাং এদের রুখে দেওয়ার, এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার এখনই সময়।
বাঙালির সর্বজনীন উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান উৎসব পহেলা বৈশাখ। মুঘল সম্রাট আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য যে বর্ষগণনা শুরু করেছিলেন সময়ের পথ বেয়ে সেটি আজ পরিণত হয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম আবেগে।
বাংলা বছরের প্রথম দিনটি বাঙালি উদযাপন করে উৎসবে। বরণ করে আনন্দ হিল্লোলে। নোটিশে বলা হয়েছে—মঙ্গল শোভাযাত্রা নাকি কৃত্রিম উদ্ভাবিত! কিন্তু ফসল তোলার সময়ে খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য তার মন্ত্রিসভার নবরত্নের পরামর্শে বাংলা সন গণনা চালু করেন। এর আগে সব হতো চন্দ্রবর্ষ অনুযায়ী। তো, লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো মাহমুদুল হাসানের ভাষায় মঙ্গল শোভাযাত্রা যদি কৃত্রিম উদ্ভাবিত বিষয় হয়, তাহলে তো বলতে হয় বাংলা সন গণনাই কৃত্রিম উদ্ভাবিত।
লিগ্যাল নোটিশে বলা হয়েছে—মঙ্গল শব্দটি ধর্ম সংশ্লিষ্ট শব্দ। সব ধর্মের লোকজন তাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে ‘মঙ্গল’ প্রার্থনা করেন। তাই বর্ষবরণের শোভাযাত্রায় ‘মঙ্গল’ শব্দ ব্যবহারে তার আপত্তি। কারণ মঙ্গল শোভাযাত্রায় মাছ, পাখি ইত্যাদির ভাস্কর্য ব্যবহার করা হয়।
বাঙালির সর্বজনীন উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান উৎসব পহেলা বৈশাখ। মুঘল সম্রাট আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য যে বর্ষগণনা শুরু করেছিলেন সময়ের পথ বেয়ে সেটি আজ পরিণত হয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম আবেগে।
ভাস্কর্য আর আর মূর্তির পার্থক্য বুঝতে না পারা ধর্মান্ধদের বক্তব্যের সঙ্গে তার এই বক্তব্যের কোনো তফাত আছে বলে আমার মনে হয় না।
পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে, পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী এই দেশে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করেছিল। কাজী নজরুল ইসলামের গান কবিতায় তাদের ইচ্ছেমতো শব্দ বসিয়ে সেটি ইসলামীকরণের চেষ্টা করেছিল।
আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব দিয়েছিল। পাকিস্তানিদের এসব ঔদ্ধত্যপূর্ণ কাজের সঙ্গে সুর মিলিয়েছিল কতিপয় বাঙালি। এখন স্বাধীনতার এত বছর পরেও সেই পাকিস্তানিদের প্রেতাত্মারা এই দেশে এখনো রয়ে গেছে। সময় সময় নানা ইস্যুতে সেই নজির আমরা দেখতে পাই। এই লিগ্যাল নোটিশ তারই একটি নমুনা মাত্র।
এই দেশে কেন রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হয়, কেন উদীচীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হয়, কেন সিনেমা হলে বোমা হামলা হয়—এইবার কিছুটা ধারণা পাওয়া গেছে?
এক শ্রেণির লোকদের আজকাল বলতে শুনছি—বৈশাখী মেলা আমাদের ঐতিহ্য, কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রা ঐতিহ্য নয়। কেন ঐতিহ্য নয়? তাদের কথা হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়েছে ১৯৮৯ সাল থেকে। এর আগে এটি ছিল না। কিন্তু পহেলা বৈশাখে মেলা হয়ে আসছে আবহমান কাল থেকেই। সুতরাং মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের ঐতিহ্য নয়।
আচ্ছা, শুরুতে না থাকলেও তিন দশকে দেশের আপামর মানুষের অংশগ্রহণে এটি কি মানুষের প্রাণে জায়গা করে নেয়নি? মানুষ কি এখানে দলে দলে ভিড় জমায় না? আচ্ছা সব না হয় বাদ।
ইউনেস্কো কোনো বিচার বিশ্লেষণ বিবেচনা ছাড়াই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব ঐতিহ্য বলে ঘোষণা করেছে? আসলে যারা জেগে ঘুমায়, তাদের জাগানোর কিছু নেই। শুধু প্রার্থনা করি তাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। মনে আলো জাগ্রত হোক। মনের অন্ধকার দূর হোক।
জঙ্গিদের নানা উল্লম্ফন, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর নানা অপতৎরতাসহ বিভিন্ন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মঙ্গল শোভাযাত্রা কয়েক বছর ধরেই কঠোর নিরাপত্তার ঘেরাটোপে।
সামনে পেছনে বন্দুকধারী পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার লোকজন মঙ্গল শোভাযাত্রাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বেশ কিছুদিন ধরেই। হয়তো যৌক্তিক কারণেই এটি করতে হচ্ছে। কিন্তু এর ফলে মঙ্গল শোভাযাত্রা উৎসব উদযাপনের চেয়ে অনেকটাই আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে।
চারুকলা থেকে শুরু হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রায় আগে মাঝপথেও মানুষ অংশ নিতে পারতো। কিন্তু এখন নিরাপত্তার কারণে শুরুর সময় যারা থাকবেন, তারা ছাড়া মাঝপথে আর কেউ যুক্ত হতে পারেন না। আমি বলি, এবার অন্তত আগের মতো উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক।
কঠোর নজরদারি থাক কিন্তু সেই শোভাযাত্রায় সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হোক। কতিপয় সংকীর্ণ মনের লোকের দুষ্টু অভিলাষের কাছে বাঙালির প্রাণের উৎসব ম্লান হতে পারে না। হতে দেওয়া যায় না। হবে না।
সেই ব্রিটিশ ভারত থেকে শুরু করে পাকিস্তানি শোষণ, এমনকি দেশের কাঁধে বিভিন্ন সময় চড়ে বসা স্বৈরাচারী শাসন, যখন বাধা এসেছে, বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছে। কখনো প্রাণ দিয়েছে, কখনো জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবনের বিনিময়ে অর্জন করেছে অভীষ্ট লক্ষ্য। এখনো তাই হবে।
ষাটের দশকে আমাদের এখানে বলিষ্ঠ সাংস্কৃতিক চর্চা ছিল বলেই আমরা একাত্তরে একটি রাজনৈতিক জনযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করেছিলাম। সংস্কৃতি শুধু মনের বিকাশ ঘটায় না, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজনীতিও এগিয়ে দেয় কয়েক ধাপ।
যত সমালোচনা করা হবে, যত রুদ্ধ করার চেষ্টা করা হবে—ততই ফুলে ফেঁপে উঠবে আমাদের প্রাণের উৎসবগুলো। ডালপালা মেলে সর্বগ্রাসী বিস্তারে রোধ করবে কূপমণ্ডূকদের কুটিল চিন্তা। বাঙালি কখনো হারেনি। হারবেও না।
কথায় কথায় আমরা বলি—আমাদের দেশটা ইদানীং কেমন যেন হয়ে গেছে। আমাদের দেশে দুর্নীতির বিস্তার হয়েছে। সহনশীলতা কমে গেছে। আমাদের রাজনীতি পঙ্কিলে পড়ে গেছে। এসবের মাঝে সত্যতা আছে, স্বীকার করি। কিন্তু গোঁড়ামির কারণ কী? সেটা কি আমরা খতিয়ে দেখেছি?
যদি দেখতাম, তাহলে বুঝতাম আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চা কমে গেছে। আমাদের খেলার মাঠ কমে গেছে। আমাদের সৃষ্টিশীল চর্চা কমে গেছে। সৃজনশীল-প্রগতিশীল মানুষ কমে গেছে। ফলে ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক এবং কুটিল চিন্তার লোক বেড়ে গেছে।
সুতরাং আসুন রুখে দাঁড়াই আমাদের সংস্কৃতি বিরোধী কথা এবং কাজের বিরুদ্ধে।
এডিএস/