• ঢাকা শনিবার
    ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ফুটপাতের ব্যবসা ও চাঁদাবাজি নিয়ে নতুন ভাবনা

প্রকাশিত: অক্টোবর ১২, ২০২২, ০২:৪৭ এএম

ফুটপাতের ব্যবসা ও চাঁদাবাজি নিয়ে নতুন ভাবনা

শঙ্কর মৈত্র

ফুটপাত কেবলমাত্র পথচারীদের জন্য। এটা কোন ভাবেই বানিজ্যিক ব্যবহারে নেয়া যাবে না। এমনই নিয়ম। সেই নিয়মকে অনিয়ম করে ঢাকার ৯৫ ভাগ ফুটপাত চলে গেছে হকারদের দখলে। এতে আইনের লঙ্ঘন হলেও বিষয়টির প্রতি পাবলিক পারসেপশন একেবারে নেগেটিভ নয়। কারণ কিছু মানুষের যেমন কর্মসংস্থান হয়েছে তেমনি সাধারণ মানুষও কিছু সুবিধা পাচ্ছে। অপছন্দ হলো এই যে, এখান থেকে যে চাঁদা উঠছে তা জনকল্যাণে যেতে পারছেনা।

এ প্রসঙ্গে একজন চাঁদা আদায়কারী ‍‍`পাতিনেতা‍‍` বললেন তার অধিনস্থ ফুটপাত থেকে প্রতি মাসে আদায় হয় চার লাখ টাকা। এ থেকে প্রতি মাসে স্থানীয় ডিসি (পুলিশ) অফিসকে দিতে হয় ১ লাখ। রাস্তার দুই পাশে দুই থানার লাইন। দুই থানাকে দিতে হয় ৫০ হাজার করে ১ লাখ । বিদ্যুতের লোকজন, সিটি করপোরেশনের লোকজনকে দিতে হয়। এর পর যা থাকে সেটা দিয়ে কর্মিদের খরচ, ক্লাবের খরচপাতি দিয়ে খুব একটা থাকে না।

ফুটপাতের চাঁদাবাজি নিয়ে ওই পাতি নেতাকে বললাম এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়িদের কাছ থেকে চাঁদা না নিলে হয় না?

পাতি নেতা বললেন, না এতে বিশৃংখলা দেখা দেবে। মারামারি হবে। চাঁদা নেয়ায় একটা শৃঙ্খলা থাকে। যার যে জায়গা সেখানে বসতে পারে। তিনি এটাকে চাঁদা বলতে নারাজ। বললেন এটা ভাড়া। তারা ব্যবসা করবে, লাভ করবে। ভাড়া দেবে না কেনো? এটা নাকি রেওয়াজও। ফুটপাতে ব্যবসা করতে হলে ভাড়া দিতেই হবে। বলেন, আমরা চাঁদা না নিলেও পুলিশ, বিদ্যুতের লোকজন নিয়মিত নিবেই। তারা নিজেরা ভাগ করে নেয় আর আমাদের দল চালাতে হয় কর্মিদের পেছনে খরচ করতে হয়। আমাদেরওতো সংসার আছে। আরও নানা যুক্তি দিলেন।

এসবের অনেককিছুই অযৌক্তিক। তবে সিস্টেম যেহেতু দাঁড়িয়ে গেছে সেটা ভাঙ্গা যাবে না। বছরের পর বছর ধরেই এটা চলছে।

ঢাকার রাস্তায় টাকা ওড়ে এটা সত্য। প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকা চাঁদা ওঠে শুধু ফুটপাত থেকে। চাঁদা না দিয়ে ফুটপাতে বসে ভিক্ষুকও ভিক্ষা করতে পারে না। ফুটপাতের চাঁদাবাজি নিয়ে খুনোখুনি হয়। ফুটপাতে চাঁদাবাজি করে কতোলোক কোটিপতি হয়েছে। এসব পুরনো গল্প।

ফুটপাতের ব্যবসার একটা বৈধতা দেয়া দরকার। এমনি চাঁদাবাজি না করে, রাজনৈতিক নেতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিদ্যুতের লোকজন, সিটি করপোরেশনের লোকজনকে ঘাটে ঘাটে চাঁদা না দিয়ে সমন্বিতভাবে এর বৈধতা দেয়া যেতে পারে। যেমন ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মাসে নির্ধারিত ভাড়া দেবে সিটি করপোরেশনকে। ব্যবসা ও স্থান অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারিত হবে। সিটি করপোরেশন থেকে মাসে ভাড়ার নির্ধারিত রসিদ আনতে হবে। ভাড়া ব্যাংকে পরিশোধ করতে হবে (না হয় টাকা চুরির সম্ভাবনা আছে)। সেই টাকা থেকে বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করা হবে, পুলিশকেও পারিশ্রমিক দিতে হবে। এভাবে নানাদিক বিবেচনা করে একটা গাইডলাইন তৈরী করে ফুটপাতের ব্যবসার বৈধতা দেয়া যেতে পারে। এতে সিটি করপোরেশনের আয় কয়েক কোটি টাকা বাড়বে। না হয় এখন বা বছরের পর বছর যা হচ্ছে তাতে এককভাবে কিছু নেতা, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মী লাভবান হচ্ছে। তাদের পকেটে চাঁদাবাজির টাকা যাচ্ছে।

ঢাকা শহরে ফুটপাতের ব্যবসা বন্ধ করা যাবে না। মাঝে মাঝে যারা উদ্যোগ নেন এর পেছনে থাকে নানা কারণ। বলা হয়, অভিযানের পর চাঁদার পরিমাণ বাড়ে। এগুলো এখন সবাই জানে।

ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসা থেকে হাজার হাজার সংসার চলে। তাদের বিকল্প কোনো পথের সন্ধান কেউ দিতে পারেন নি। হকারদের পুনর্বাসনের নাম করে মার্কেট বানিয়ে টাকা লোপাট করেছেন সাবেক মেয়র খোকা, খোকনসহ অনেকেই। কাজেই মার্কেট বানিয়ে পুনর্বাসনের স্বপ্ন আর দেখানোর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্ন বিদ্ধ।

উল্লেখ্য কয়েকবছর আগে জনস্বার্থে এক রিট মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গুলিস্তান থেকে কোর্টকাছারি পর্যন্ত সড়ককে সুপার এক্সপ্রেস ঘোষণা করে রাস্তায় সব ধরণের হকার বসা নিষিদ্ধ করেছিলো হাইকোর্ট। এক আইনজীবী রিটটি করেছিলেন তিনি জ্যামের কারণে নির্ধারিত সময়ে আদালতে যেতে পারেন নি বলে। রাস্তায় হকার বসার কারণে যান চলাচল করতে পারে না ফলে জ্যামের সৃষ্টি হয়। এটা শতভাগ সত্য। বছরের পর বছর ধরে এটা দেখে আসছি।

হাইকোর্টের এই আদেশের পর কয়েকদিন পুলিশ নেমেছিল। কিন্তু এই কয়েকদিনই। তারপর যথা পূর্ব অবস্থা। এখন এই আদেশ তামাদি হয়ে গেছে।

ঢাকার জনসংখ্যা, মানুষের অভ্যাস, আচার আচরণ আর্থিক অবস্থাসহ সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে এটা স্পষ্ট বলা যায় ফুটপাত হকারমুক্ত করা সম্ভব হবে না।

যেখানে হাইকোর্টের আদেশ কার্যকর হয় না, আদেশ কেউ মানে না সেখানে বিকল্প চিন্তাকরা উচিত যাতে ব্যক্তির পকেটের চেয়ে রাষ্ট্রের কোষাগারে টাকা জমে।

সময়ের প্রয়োজনে অবৈধকে বৈধতা দেয়া যেতেই পারে। আর এটা তো সত্য, প্রয়োজনীয়তা আইন মানে না।

লেখক: শঙ্কর মৈত্র, আইন আদালত বিটের সিনিয়র সাংবাদিক।

আর্কাইভ