
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৫, ২০২৫, ০৯:১১ পিএম
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সন্দেহ করে গুজব ছড়িয়ে কিংবা জনমনে ক্ষোভ তৈরি করে সংঘটিত কয়েকটি গণপিটুনির ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে তিন বছরের কন্যার সামনে বাবাকে গণপিটুনির পাশাপাশি চোর সন্দেহে পিটিয়ে দুই ভাইকে মেরে ফেলার মতো ঘটনাও ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির হিসেবে, গত বছর অগাস্ট থেকে চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত অন্তত ১১৯ জনের মৃত্যুর হয়েছে গণপিটুনিতে। ২০২৪ সালে এ ধরনের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১৭৯ জনের, যা এই দশকের মধ্যেই সর্বোচ্চ।
অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন বা এমএসএফ বলছে, মার্চ মাসে গণপিটুনির ৩৯টি ঘটনায় অন্তত ১৩ জন নিহত ও ৫৬ জন গুরুতর আহত হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিলো ১৮টি। আর জানুয়ারিতে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিলো ২১ জন।
এমএসএফ এর নির্বাহী পরিচালক ও আইনজীবী সাইদুর রহমান বলছেন, গণপিটুনির প্রবণতা আবার বেড়েছে। তিনি মনে করেন, এর কারণ হলো পুলিশি কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয়তা এবং এসব ঘটনার পর দৃশ্যমান জোরালো পদক্ষেপ না থাকা।
"পুলিশ প্রশাসন ততটা সক্রিয় না। আবার অনেকে ভাবে গণপিটুনি দিলে কোন কিছু হয় না বা এসব ঘটনার বিচার হয় না। আর মাঠ পর্যায়ে স্থানীয় সরকার না থাকারও একটা প্রভাব পড়ছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ডঃ তৌহিদুল হক বলছেন, গণপিটুনির ক্ষেত্রে দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে সফলতা একেবারেই জিরো।
"এটাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে জোরালো ব্যবস্থা না নেয়া , অর্থাৎ আইনের প্রয়োগ ঘাটতির কারণেই গণপিটুনির ঘটনা বাড়ছে," বিবিসি বাংলাকে বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মি. হক।
পুলিশ অবশ্য বলেছে, কোথাও কোন ঘটনা ঘটলেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে এবং একই সঙ্গে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে পুলিশী কার্যক্রম জোরদার হয়েছে।
এর আগে পুলিশ সদর দপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিলো কেউ অন্যায় করলে বা অপরাধী হলে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ওই ব্যক্তির বিচারের বিধান রয়েছে, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারও নেই।
"কোনো ব্যক্তি অন্যায় এবং অপরাধ করলে তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে। কোনোভাবেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না," ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিলো।
সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার ধরন
বাংলাদেশে গণপিটুনির ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এ ধরনের ঘটনার আগে গুজব ছড়িয়ে কিংবা একটি অজুহাত দাঁড় করিয়ে তাৎক্ষণিক জনমত তৈরি করে কোন ব্যক্তির ওপর হামলা হয়।
চোর, ডাকাত ও ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা বেশি হলেও রাজনৈতিক কারণেও গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলার উদাহরণও আছে।
মূলত গত বছর অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে ও পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় `মব হামলা`র ঘটনা ঘটতে থাকে। অগাস্টের পর কয়েক মাস ধরে তখন এসব ঘটনার বিরুদ্ধে সক্রিয় ও কার্যকর কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
ডঃ তৌহিদুল হক বলছেন, চুরি, ডাকাতি বা ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনির পাশাপাশি বিগত সরকারের সমর্থকদের অনেককে `গণপিটুনি দিয়ে গণশিক্ষা` দেয়ার ঘটনা ঘটেছে নানা জায়গায়। আবার বিদেশে থেকে কেউ কেউ সামাজিক মাধ্যমে গণপিটুনির উস্কানিও দিচ্ছেন, যা এসব ঘটনা ঘটাতে অনেককে উৎসাহিত করছে।
"এটাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে জোরালো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। আইনের প্রয়োগে ঘাটতি থাকার কারণে গণপিটুনির ঘটানোর সাহস দেখাচ্ছে ও অনেক ক্ষেত্রে একটি গোষ্ঠী এসব ঘটনাকে সামাজিক বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করছে," তিনি বলেন।
সম্প্রতি কিশোরগঞ্জে তিন বছরের মেয়ের সামনেই গণপিটুনির শিকার হয়েছেন শহরের পৌর এলাকার বাসিন্দা সোহেল মিয়া। মেয়ে কান্না করছিলো বলে তাকে ছেলেধরা সন্দেহ করে হামলা করা হয়। পরে তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন যে এ সময় তাকে কোন কথা বলারই সুযোগ দেয়া হয়নি।
সম্প্রতি স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর তার কাছে থাকা কন্যা মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কান্না করায় তিনি কন্যাকে নিয়ে সাবেক স্ত্রীর খোঁজে যান। কিন্তু তাকে না পেয়ে মেয়েকে নিয়ে যখন অটোরিকশায় ফিরছিলেন তখন সে মা মা করে কান্না করছিলো।
এ সময় তাতারকান্দি এলাকায় মেয়ের কান্না শুনে ছেলেধরা সন্দেহ করে স্থানীয় কয়েকজন সোহেলকে অটোরিকশা থেকে নামিয়ে মারধর শুরু করে। এ সময় তার মেয়ে বাবা বাবা করে কাঁদছিল। পরে পুলিশ গিয়ে বাবা-মেয়েকে উদ্ধার করে ও সোহেলকে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। সেখানকার পুলিশ জানিয়েছে এ ঘটনায় থানায় জিডি হয়েছে।
নরসিংদীতে গত ৩১শে মার্চ চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে দুই ভায়ের মৃত্যুর ঘটনাটিও আলোচনায় এসেছিলো। এ ঘটনায় তাদের পিতা-মাতাও আহত হয়েছিলেন। পরে গণপিটুনির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তিন জনকে আটকের কথা জানিয়েছে পুলিশ।
এগুলো ছাড়াও আরও কয়েকটি গণপিটুনির ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। এর মধ্যে একটি ভিডিওতে দেখা গেছে পুকুরের পানিতে নেমে দাঁড়িয়ে আকুতি জানাচ্ছে একটি ছেলে। আর পুকুর পাড়ে শত শত মানুষ।
এক পর্যায়ে তাকে ধরতে একজন পানিতে নামলে সে উপরে উঠে আসলে লোকজন তাকে মারতে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কী অবস্থা হয়েছে তা আর ভিডিওতে দেখা যায়নি।
ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের সিলেটি বাজার এলাকায় জনতার পিটুনিতে দুইজন নিহত এবং আরো কয়েকজন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে গত বুধবার।
এলাকায় বোমাবাজির ঘটনার জের ধরে স্থানীয়দের হাতে তারা গণপিটুনির শিকার হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
কাউকে কেবল সন্দেহের বশে অপরাধী মনে করে তাৎক্ষণিক জনমত তৈরি করা এবং পরে গণপিটুনি দিয়ে হতাহত করা বাংলাদেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। অতীতে এরকম ঘটনায় অনেক নিরীহ ও সাধারণ মানুষের মৃত্যুর উদাহরণও রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের প্রচলিত আইন ও তদন্ত ব্যবস্থায় গণপিটুনিতে শাস্তি নিশ্চিত করা বেশ কঠিন। এ কারণে গণপিটুনিতে অংশ নেয়ার অপরাধে বাংলাদেশে কারো দণ্ড হওয়ার নজির বাংলাদেশের আদালতে বিরল বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা।
"এই বিচার না হওয়ার বিষয়টি গণপিটুনির মতো অপরাধ বৃদ্ধির বড় কারণ," বিবিসি বাংলাকে বলেছেন মানবাধিকার সংগঠক সাইদুর রহমান।
ডঃ তৌহিদুল হক বলছেন, একদিকে পুলিশের শতভাগ সক্ষমতা এখনো ফিরে আসেনি। আবার অন্যদিকে ঘটনার খবর পেলেও অনেক সময় তারা এগুতে চায় না পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার আশংকায়।
"অনেক পরিকল্পিত গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। পুলিশ ভাবে তারা হস্তক্ষেপ করে কোন ঝামেলায় পড়েন কি-না কিংবা তাদের কোন বিশেষণ দিয়ে আবার উল্টো বিপদে ফেলা হয় কি-না। একটা উভয় সংকটে ভোগেন তারা। কারণ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বিরোধেও যেমন গণপিটুনি হচ্ছে আবার কেউ অর্থ আদায়ের জন্য এই অপরাধকে ব্যবহার করছেন," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তার মতে গণপিটুনি ছোঁয়াচে রোগের মতো এবং সে কারণে একবার কোথাও ঘটলে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে অন্য জায়গাতেও ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলে অনেক এটিকে ব্যবহারের পথ বেছে নেয়।
এ জন্য এটি বন্ধে দ্রুত কার্যকর আইনি ব্যবস্থা নেয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা