
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২৫, ১০:৪৬ পিএম
বিদ্যমান ‘আসনভিত্তিক’ নাকি ‘সংখ্যানুপাতিক’ পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ আছে। কাজেই এ বিষয়ে কোনো সুপারিশ করেনি নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে যে পদ্ধতিতেই নির্বাচন হোক না কেন, জাতীয় সংসদের কোনো আসনে ৪০ শতাংশের কম ভোট পড়লে সেখানে আবারও নির্বাচন হবে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বিদ্যমান আসনভিত্তিক পদ্ধতি ও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিক তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া বর্তমান সরকারের সংস্কার কার্যক্রম অনুমোদনে গণভোটের বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে গণভোট কার্যকরের বিষয়ে ইতিবাচক মতামত দেওয়া হয়েছে। সেখানে আগামী সংসদে গণভোট পাশ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
শনিবার পূর্ণাঙ্গ ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
ড. বদিউল আলম মজুমদারকে প্রধান করে আট সদস্যের সংস্কার কমিশন গঠন করে গত বছরের ৩ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। ওই সময়ে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা ছিল। ১৫ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সুপারিশ জমা দেয় এ কমিটি। সেখানে ১৬ দফায় দেড়শ সুপারিশ করে। কয়েক দফায় সময় বাড়ানোর পর শনিবার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়েছে।
বিদ্যমান নির্বাচন পদ্ধতি বিষয়ে ১৯৯১, ১৯৯৬ (১২ জুন), ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রাপ্ত ভোট ও আসন সংখ্যা তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। বিদ্যমান নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে এতে বলা হয়েছে, আসনভিত্তিক পদ্ধতির অনেক গুরুতর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এর অন্যতম হলো এ পদ্ধতিতে অনেক সময় রাজনৈতিক দল তাদের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে আসন পায় না। বিদ্যমান পদ্ধতিতে সংসদে রাজনৈতিক দলের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না।
এতে আরও বলা হয়েছে, এ পদ্ধতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সরকারগুলো ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে অতীতে একাধিকবার সংবিধান সংশোধন করেছে, যা আমাদের দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার সৃষ্টি করেছে।
অপরদিকে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির বিষয়ে বলা হয়েছে, এই পদ্ধতি চালু থাকলে পঞ্চম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোট হারের প্রায় সমতার কারণে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আসন প্রায় সমানে সমান হতো। একইভাবে সপ্তম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ভোট প্রাপ্তির হারে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা নির্ধারিত হতো। ফলে এই চারটি নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ কারও পক্ষেই এককভাবে সরকার গঠন সম্ভব হতো না। উভয় দলকেই অন্য কোনো দলের বা দলগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গঠন করতে হতো। এর ফলে এককভাবে নিজেদের স্বার্থে কোনো দলই সংবিধান সংশোধন করতে পারত না। আওয়ামী লীগের পক্ষে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা সম্ভব হতো না। এ পদ্ধতি চালু হলে বড় দলগুলো ছোট দলগুলোর কাছে জিম্মি হওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করা হয়েছে। এভাবে দুই পদ্ধতির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক ঐকমত্যের অভাবের কারণে নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের বিষয়ে কোনো রূপ সুপারিশ করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে ১৮টি ক্ষেত্রে সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে। নির্বাচনের প্রধান আইন আরপিওসহ বিভিন্ন আইন, বিধিমালা ও নীতিমালায় সংশোধনী সংযুক্তি হিসাবে দেওয়া হয়েছে। এতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ৪ মাস নির্ধারণ করা, সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুবার নির্ধারণসহ দুই শতাধিক সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের ভয়াবহ কারচুপি এবং এই প্রক্রিয়ায় সরকার গঠনসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হয়। তিন নির্বাচন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর কারচুপি নির্বাচনের পুরোনো সংস্কৃতি দেশে ফিরে আসে। এতে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা নির্বাচন কমিশনারদের আইনের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে।
লেজুড়ভিত্তিক সংগঠন বিলুপ্তি : নির্বাচন অর্থবহ করতে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচ্ছন্ন, স্বচ্ছ ও দলের নেতাকর্মীদের কাছে দায়বদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলের লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র, শিক্ষক ও শ্রমিক সংগঠন এবং বিদেশি শাখাকে বিলুপ্তির সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া যারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য তাদের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক সদস্য এবং কোনো কমিটির সদস্য হওয়া থেকে বিরত রাখার কথা বলা হয়েছে। এ সুপারিশ কার্যকর হলে আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি, ঋণখেলাপি ও বিলখেলাপিরা দলীয় পদে থাকতে পারবেন না।