• ঢাকা সোমবার
    ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১
প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়নের প্রভাব

চাকরি হারাতে পারে ১৮ লাখ মানুষ

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৮, ২০২৪, ১১:৪৩ পিএম

চাকরি হারাতে পারে ১৮ লাখ মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

বাংলাদেশে প্রযুক্তিগত দক্ষতার উন্নয়ন ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি হলে প্রায় ১৮ লাখ মানুষ চাকরিহারা হতে পারেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাত। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি গবেষণায় এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত বিআইডিএস-এর বার্ষিক গবেষণা সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘প্রযুক্তি, সাপ্লাই চেইন এবং প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান’ শীর্ষক অধিবেশনে এ গবেষণাটি উপস্থাপন করা হয়।

অধিবেশনটি পরিচালনা করেন ইকোনমিক রিসার্চ গ্রপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ জহির। গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন বিআইডিএস-এর গবেষণা সহযোগী ফারহিন ইসলাম।

সংস্থাটির মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন, গবেষক ড. মনজুর হোসেন, ড. কাজী ইকবাল এবং জায়েদ বিন সত্তারও পৃথক গবেষণাপত্র তুলে ধরেন এবং বক্তব্য দেন। এ সময় অপর এক গবেষণায় বলা হয়, দেশের তৈরি পোশাক খাতে নারীর অংশগ্রহণ কমছে। ২০১৪ সালে দেশের এ খাতের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৫৬ শতাংশ। ২০২৩ সালে সেটি নেমে এসেছে ৫৩ শতাংশে।

বিআইডিএস-এর গবেষণা সহযোগী ফারহিন ইসলাম জানান, প্রযুক্তির উন্নয়ন হলে শুধু তৈরি পোশাক খাতে ১০ লাখ মানুষের চাকরি হারানোর আশঙ্কা করা হয়েছে। গবেষণায় আরও কিছু ক্ষতিগ্রস্ত খাত হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। যেমন: অধাতু, খাদ্যপণ্য, চামড়া ও চামড়াসামগ্রী, ফার্নিচার, ফার্মাসিউটিক্যালস, প্লাস্টিক ও রাবারশিল্প। সলো গ্রোথ মডেল ব্যবহার করে ফারহিন ইসলাম দেখান, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে উৎপাদনশীলতা বাড়লে বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে ১৮ লাখ কর্মীর কাজ চলে যেতে পারে। তবে শুধু তৈরি পোশাক খাতই নয়, কোন খাতে এবং কোন এলাকায় কত মানুষের কাজ চলে যেতে পারে, এরও সম্ভাব্য হিসাব দেওয়া হয় এই গবেষণাপত্রে।

কর্মসংস্থান হ্রাসের এ হিসাব করা হয়েছে উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধির হার ধ্রুব রেখে। বলা হয়েছে, এ খাতের ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি সত্ত্বেও নতুন যত কর্মসংস্থান হবে, তা ছাঁটাইয়ের চেয়ে বেশি। ফারহিন আরও বলেন, ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে উৎপাদন খাতে ২০ লাখ কর্মসংস্থান হবে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, কাগজের পণ্য, কোক, পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম, খনিজ পণ্য এবং কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিক্স নির্মাণ খাতে চাকরি বৃদ্ধি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ফারহিন ইসলাম আরও বলেন, যেসব খাতে প্রযুক্তি ব্যবহার হবে মানবশ্রমের সহায়ক শক্তি হিসাবে, সেসব খাতে ছাঁটাই হবে কম। আর যেখানে মানবশ্রমের বিকল্প হিসাবে প্রযুক্তির ব্যবহার হবে, সেখানে ছাঁটাই হবে বেশি। যতটা বেকারত্ব আমরা অনুমান করেছি, তা শ্রম প্রতিস্থাপনকারী প্রযুক্তির চেয়ে শ্রম-বর্ধনকারী প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেক কম হবে এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শ্রমশক্তির উন্নয়ন জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

ফারহিন আরও বলেন, তবে যদি আমরা শ্রমশক্তিকে দক্ষ করে তুলতে পারি, তবে আমরা উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারব। সেই সঙ্গে চাকরি বজায় রাখতে পারব। সরকারকে শ্রমশক্তি উন্নয়নের জন্য আরও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। অধিবেশনে আলোচনা হয়েছে, প্রযুক্তি গ্রহণের সময় তার সামাজিক প্রভাব বিবেচনায় নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

ড. বিনায়ক সেন বলেন, প্রযুক্তির প্রভাব কীভাবে লিঙ্গভিত্তিক কর্মসংস্থানে প্রভাব ফেলতে পারে, সেটিও গবেষণার বিষয় হওয়া উচিত।

অপর এক অধিবেশনে ‘টেকনোলজি আপগ্রেডেশন ইন আরএমজি ইন্ডাস্ট্রিজস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন বিআইডিএস-এর গবেষণা পরিচালক ড. কাজী ইকবাল। তিনি বলেন, দেশের তৈরি পোশাক খাতে নারীর অংশগ্রহণ কমছে। ২০১৪ সালে দেশের এ খাতের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৫৬ শতাংশ। ২০২৩ সালে সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ৫৩ শতাংশে।

গবেষণায় দেখা যায়, ১০ বছরে তৈরি পোশাক খাতের বেশির ভাগ উপখাতে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে। এ খাতের আটটি উপখাতের মধ্যে ছয়টিতেই কমেছে নারীর অংশগ্রহণ। কাজী ইকবাল দেখিয়েছেন, ১০ বছরে তৈরি পোশাকের উপখাতগুলোর মধ্যে শুধু হোম টেক্সটাইল ও ওভেন খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। বাকি ছয়টি খাত অর্থাৎ নিট লিনজারি, ডেনিম ট্রাউজার, সোয়েটার, টি-শার্ট, জ্যাকেট, ওভেন ট্রাউজার ও ওভেন শার্টে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ কমেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে জ্যাকেটে। এই উপখাতে ২০১৪ সালে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ ছিল ৬৩ দশমিক ১৩ শতাংশ; ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ২২ শতাংশে।

উপস্থাপনায় বলা হয়, তৈরি পোশাক খাত গত ১০ বছরে অনেক বেশি পুঁজিঘন হয়েছে। সেই সঙ্গে শ্রমিকপ্রতি যন্ত্রের সংখ্যা কমেছে। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে মেশিন অপারেটর ও হেলপারদের ওপর। সামগ্রিকভাবে তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বেড়েছে। নারী শ্রমিকদের সংখ্যা কমার সঙ্গে যে আরেকটি পরিবর্তন গত ১০ বছরে হয়েছে, তা হলো উৎপাদন খাতে প্রযুক্তি জানা মানুষের কর্মসংস্থান বেড়েছে। এই খাতে বিএসসি ও ডিপ্লোমা টেক্সটাইল প্রকৌশলী বেড়েছে। কিন্তু টেক্সটাইল প্রকৌশলে নারীর সংখ্যা খুবই নগণ্য। এছাড়া বিএসসি শিল্প প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমা শিল্প প্রকৌশলীর সংখ্যা বেড়েছে। ডিপ্লোমা শিল্প প্রকৌশলীর পেশা তুলনামূলকভাবে নতুন। তবে এ খাতে সম্প্রতি কয়েক বছরে নারীরা এসেছেন। এ খাত গত ১০ বছরে অনেক বড় হয়েছে বলে নন-টেকনিক্যাল মানুষের সংখ্যাও দ্বিগুণ হয়েছে, যা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

গবেষণা সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বিআইডিএস-এর মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, এই যে প্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে, এর সামাজিক প্রভাব আছে। বিষয়টি কি একেবারে বাজারের হাতে দেওয়া হবে, নাকি এখানে নারীদের অংশগ্রহণের হার বজায় রাখতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে কাজী ইকবাল বলেন, নারীরা কোথায় কোথায় প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে সমস্যার মুখে পড়ছেন, তা চিহ্নিত করে তাদের নতুন দক্ষতা শেখানো দরকার। তাহলে নারীদের এই ঝরে পড়ার হার রোধ করা সম্ভব।

এ প্রসঙ্গে ড. মঞ্জুর হোসেন বলেন, দেশে এ মুহূর্তে প্রযুক্তির কারণে বড় ধরনের ছাঁটাই হচ্ছে, তা নয়। এর প্রভাব আছে। চীনের একটি গবেষণার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, চীনে প্রযুক্তির কারণে ৩ শতাংশ ছাঁটাই হলেও ২ শতাংশ নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া সবখানেই থাকবে। ফলে দরকার হচ্ছে, নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা বা তাদের নতুন দক্ষতা শেখানো এবং প্রয়োজনবোধে নতুন জায়গায় নিয়ে যাওয়া।

অপর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের তৈারি পোশাক (আরএমজি) খাত, যা দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এলডিসি (স্বল্পোন্নত) উত্তরণের পর গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে চলেছে। বিশেষ করে সরবরাহ চেইন ঠিক রাখাই অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেবে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় টেকসই সমাধানের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এটি উপস্থাপন করেন বিআইডিএস-এর গবেষণা পরিচালক ড. মনজুর হোসেন। সেখানে আগামী দিনে আরএমজি শিল্পের যে চ্যালেঞ্জগুলোর সম্মুখীন হতে হবে, তা তুলে ধরা হয়। গবেষণাটি তৈরিতে সহযোগী ছিলেন বিআইডিএস-এর গবেষণা ফেলো তাহরীন তাহরিমা চৌধুরী এবং গবেষণা সহায়ক মো. নাদিম উদ্দিন।

গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের জন্য এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন-পরবর্তী সবচেয়ে বড় উদ্বেগের একটি বিষয় হলো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ডিউটি-ফ্রি, কোটাহীন সুবিধা হারানো। ২০২৬ সালের পর বাংলাদেশ আর বড় বড় উন্নত দেশের বাজারে ডিউটি-ফ্রি সুবিধা পাওয়া যাবে না। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে যেখানে পোশাক, কাপড় এবং আধা প্রস্তুত পণ্যের ওপর ১২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপিত হতে পারে। এই সুবিধাগুলোর অবসান এবং এলডিসির জন্য বিশেষ সুবিধা হারানোর কারণে আরএমজি খাতের রপ্তানি আয় প্রায় ১০ দশমিক ৮ শতাংশ হ্রাস পাবে, যা ২০৩১ সাল নাগাদ হতে পারে। গবেষণাটি আরও সতর্ক করে দিয়েছে যে, উন্নত দেশগুলো শুল্ক আরোপ করলে বাংলাদেশের জিডিপিতে শূন্য দশমিক ৩৮ শতাংশ হ্রাস হতে পারে। আরএমজি খাতের রপ্তানি প্রায় ১৪ শতাংশ কমে যেতে পারে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয় বর্তমানে ৮৪ শতাংশ।

বাংলাদেশের কাঁচামালের ওপর নির্ভরতার বিষয়ে গবেষণায় বলা হয়েছে, ২১ শতাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেশীয় বাজার থেকে সস্তা এবং ভালো মানের কাঁচামাল সংগ্রহে মনোনিবেশ করেছে। এছাড়াও তারা তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতাকারী ছাড়াই ট্রেড ফেয়ার এবং সরাসরি অর্ডারের মাধ্যমে তাদের বাজারে প্রবৃদ্ধি ঘটানোর চেষ্টা করছে। গবেষণায় পোস্ট প্রোডাকশন পর্যায়েও বড় চ্যালেঞ্জের কথা উল্লে­খ করো হয়েছে। বিশেষত, শিপমেন্টের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাস্তার অবকাঠামো সমস্যা, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সে অদক্ষতা এবং বন্দরের কার্যক্রমে দেরি হওয়ায় বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। চট্টগ্রাম বন্দর, বিশেষত এশিয়ার সবচেয়ে অকার্যকর কনটেইনার হ্যান্ডলিং বন্দর হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে, যা রপ্তানির ক্ষেত্রে বড় বাধা সৃষ্টি করছে।

গবেষণা সম্মেলনে দিনব্যাপী দক্ষিণ এশিয়ার খাদ্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা, চালের বাজার এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়।

আর্কাইভ