• ঢাকা বৃহস্পতিবার
    ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১
টিআইবির পুরস্কার বিতরণ ও প্যানেল আলোচনা

নতুন বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে পূর্বশর্ত মুক্ত গণমাধ্যম

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৬, ২০২৪, ১১:৫৫ এএম

নতুন বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে পূর্বশর্ত মুক্ত গণমাধ্যম

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

জনস্বার্থ, জনকল্যাণকে প্রাধান্য দিয়ে “নতুন বাংলাদেশে” সাংবাদিকতার ইতিবাচক সম্ভাবনার প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০২৪ ঘোষণা ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা (আইজে) কনক্লেভ উপলক্ষে আয়োজিত প্যানেল আলোচনায় প্রত্যাশার পাশাপাশি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতের আহ্বান জানান আলোচকরা। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস ২০২৪-এর উদ্‌যাপনের শুরু করলো টিআইবি। এ দিন টিআইবির অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কারের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে পুরস্কৃত হওয়া সকল সাংবাদিক, প্রতিযোগিতার বিচারকমণ্ডলী, সিনিয়র সাংবাদিকসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষকদের নিয়ে এই কনক্লেভটির আয়োজন করে সংস্থাটি।

“দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০২৪” ঘোষণার আগে দুটি প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। “নতুন বাংলাদেশ: কেমন গণমাধ্যম চাই?” শীর্ষক প্যানেল আলোচনার শুরুতে টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের ডেপুটি কোঅর্ডিনেটর মাসুম বিল্লাহ গণমাধ্যম সংস্কারের জন্য টিআইবির সুপারিশমালা উপস্থাপন করেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঞ্চালনায় এ প্যানেল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি)-এর মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ, সিনিয়র সাংবাদিক ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ, নিউ এজ এর সম্পাদক নূরুল কবীর এবং মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল আলম।

আলোচনায় ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এটা সত্য যে, গণমাধ্যমের ওপর চাপ এখনো আছে। তবে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো যদি জনস্বার্থ, জনকল্যাণকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করতে না পারে, তাহলে এ পরিস্থিতি পরিবর্তন কখনোই হবে না। গণমাধ্যমের শীর্ষ নেতৃত্বকে সম্পাদকীয় নীতিমালাকে অক্ষুণ্ন রেখে কাজ করতে হবে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সেখানে যেন কোনো প্রভাব না ফেলে। আমরা দেখছি, বর্তমানে সাংবাদিকতার মান অবশ্যই বেড়েছে। তাই আমরা “নতুন বাংলাদেশে” সাংবাদিকতার ইতিবাচক সম্ভাবনার দিকে তাকাতে চাই, আমরা আশা হারাতে চাই না।’ নিউ এজ এর সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, ‘গণমাধ্যমকে রাজনৈতিক ইতিহাস, সামাজিক ন্যায্যতার হিসেবে সমতা রাখতে হবে। একদিকে ভয় ও অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের আনুকূল্য প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা সেল্ফ-সেন্সরশিপের দিকে নিয়ে যায়। এমন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করতে হবে।’ পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, ‘অপতথ্য-ভুলতথ্য মোকাবিলার দায়িত্ব গণমাধ্যমেরই। সঠিক তথ্য-উপাত্ত, বিশ্লেষণের প্রবাহ নিশ্চিতের মাধ্যমে আমাদের তা করতে হবে।’

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান জনাব কামাল আহমেদ বলেন, ‘বিগত সরকারের সময়ে আমরা বরাবরই সম্পাদকীয় নীতিমালাকে উপেক্ষিত থাকতে দেখেছি। জনস্বার্থকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক প্রভাবের বশবর্তী যাতে সামনের দিনে গণমাধ্যম না হয়, এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জনাব মোহাম্মদ শফিকুল আলম বলেন, ‘বিগত সরকারের সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রাধান্যের জায়গা হলো গণমাধ্যমের স¦াধীনতা। পরবর্তীতে কোনো রাজনৈতিক সরকার এসে যেন গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’

টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় “বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা” শীর্ষক আরেকটি প্যানেল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সিনিয়র সাংবাদিক ও ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ মিশনের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা, দৈনিক গ্রামের কাগজের সম্পাদক মবিনুল ইসলাম মবিন, অনুসন্ধানী সাংবাদিক মোহা: বদরুদ্দোজা এবং সিনিয়র সাংবাদিক কুররাতুল-আইন-তাহমিনা। আলোচকরা বলেন, কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পরও সেল্ফ সেন্সরশিপের চর্চা অব্যাহত রয়েছে। তবে আলোচকরা মনে করেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ কখনোই মসৃণ নয়, প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করেই সঠিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চালিয়ে যেতে হবে। সাংবাদিক, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও সরকারকে সুনির্দিষ্ট কাঠামোবদ্ধ উপায়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করে এমন পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানান বক্তারা। আলোচকরা বলেন, গণমাধ্যমকে নিজের অর্থনৈতিক সামর্থ্য বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাংবাদিকের দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০২৪ ও আইজে কনক্লেভ

দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার প্রবর্তনের পর থেকে ২৬ বছরে পুরস্কৃত হওয়া ৮৮ জন সাংবাদিক, প্রতিযোগিতার বিচারক, সিনিয়র সাংবাদিক, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষকদের নিয়ে এ বছর আইজে কনক্লেভ আয়োজন করে টিআইবি। যা দেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সংকট ও উত্তরণের উপায়, “নতুন বাংলাদেশ”-এ গণমাধ্যম প্রত্যাশা বিষয়ে আলোচনার উপলক্ষ্য হয়ে ওঠার পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়।

প্যানেল আলোচনা শেষে টিআইবির দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০২৪ ঘোষণা করা হয়। এ বছর বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৩ জন সাংবাদিক ও একটি প্রামাণ্য অনুষ্ঠানকে এই পুরস্কার দেয়া হয়। আঞ্চলিক সংবাদপত্র বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন চট্টগ্রামের “একুশে পত্রিকা ডট কম” এর প্রধান প্রতিবেদক শরীফুল ইসলাম (শরীফুল রুকন)। জাতীয় সংবাদপত্র বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন “দ্য ডেইলি স্টার”-এর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জায়মা ইসলাম, টেলিভিশন প্রতিবেদন বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন যমুনা টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আল-আমিন হক অহন। টেলিভিশন (প্রামাণ্য অনুষ্ঠান) বিভাগে বিজয়ী হয়েছে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ‘তালাশ’। বিজয়ীদের প্রত্যেককে সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট ও এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। বিজয়ী প্রামাণ্য অনুষ্ঠানটির জন্য সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট এবং এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকার পুরস্কার প্রদান করা হয় । উল্লেখ্য, টিআইবি ১৯৯৯ সাল থেকে “দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার” প্রদান করে আসছে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত ২৬ বছরে টিআইবি ৮৮ জন গণমাধ্যমকর্মীকে পুরস্কার প্রদান করেছে। এ সময়কালে জমা পড়া ১৪৪০টি প্রতিবেদনের মধ্যে ৯০টি প্রতিবেদনকে পুরস্কৃত করা হয়। পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রামাণ্য অনুষ্ঠান সংখ্যা ১৩টি, পুরস্কারপ্রাপ্ত নারী সাংবাদিক ০৭ জন ও পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্যামেরাপারসন ১৭ জন।

দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কারের ২৫ বছরের যাত্রা নিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কারকে ঢাকা বা জাতীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখিনি। ঢাকার বাইরে বিস্তৃত হওয়ার ফলে প্রতিযোগিতার মান বেড়েছে বলে আমরা মনে করি। একইসঙ্গে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে- বিষয়টি আমাদের জন্য আশাব্যঞ্জক।’

আর্কাইভ