প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৪, ১১:১০ এএম
মানুষ হত্যা, মুদ্রাপাচার, কর ও ভ্যাট ফাঁকি, দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দিলীপ কুমার আগরওয়ালাকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত ১টার দিকে রাজধানীর গুলশানের অফিস থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাত দেড়টার দিকে বহুতল ভবন ‘আকাশ টাওয়ার’ থেকে তাঁকে বাইরে নিয়ে আসে র্যাব।
এর আগে গতকাল রাত ৯টার দিকে গুলশানে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড কার্যালয়ে অভিযান চালায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-১)।
রাত ১টা পর্যন্ত তাঁর অফিস ভবন ঘিরে রেখে তল্লাশি চালায় র্যাব। প্রতিষ্ঠানটির এমডি দিলীপ আগরওয়ালার বিরুদ্ধে সোনা ও হীরা চোরাচালানসহ বিভিন্ন অভিযোগে এই অভিযান চালানো হয়।
এর আগে সোনা ও হীরা চোরাচালানের অভিযোগে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড এবং এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফিন্যানশিয়াল ক্রাইম ইউনিটের অনুসন্ধান শুরু হয়। এরপর তাঁর অফিসে অভিযান চালায় র্যাব।
রাতে অভিযানের বিষয়টি নিশ্চিত করেন র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস।
র্যাব জানায়, দিলীপ কুমার আগরওয়ালার বিরুদ্ধে বিদেশ থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে সোনা ও হীরা আমদানির নামে অর্থপাচার, প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাত সাড়ে ৯টার পর তাঁর অফিসের সামনে অবস্থান নিয়েছেন র্যাব সদস্যরা। রাত ১০টার দিকে র্যাবের একটি দল ভবনের ভেতর প্রবেশ করে।
পরে র্যাব সদস্যদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। ভবনটিতে ভেতর থেকে তালা দিয়ে তাঁরা এই অভিযান পরিচালনা করেন।
সিআইডির তথ্য মতে, তাঁর বিরুদ্ধে বিদেশ থেকে সোনা ও হীরা চোরাচালানের নামে অর্থপাচার, প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। তিনি দেশের বিভিন্ন জেলায় নামমাত্র শোরুম দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে হীরার পরিবর্তে উন্নতমানের কাচের টুকরা বিক্রি করে আসছেন। এ ছাড়া দুবাই, সিঙ্গাপুরে চোরাচালান সিন্ডিকেট, ভারতের কলকাতায় জুয়েলারির তিনটি শোরুম, ১১টি বাড়িসহ মালয়েশিয়া, দুবাই ও কানাডায় বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন।
বিপুল অঙ্কের ভ্যাট ফাঁকি, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাবেক এমপি আনার হত্যাকাণ্ডসহ সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র হত্যাকাণ্ডেও তাঁর জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এমন নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য উপকমিটির সদস্য দিলীপ কুমার আগরওয়ালার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে সিআইডি।
গতকাল বিকেলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আজাদ রহমান এ বিষয়ে বলেন, দিলীপ কুমার আগরওয়ালার বিরুদ্ধে নানা প্রতারণার পাশাপাশি বিদেশ থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে সোনা ও হীরা আমদানির নামে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত শুরু করেছে সিআইডি।
সিআইডি সূত্র বলছে, ঢাকাসহ সারা দেশে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের অন্তত ৩০টি শোরুম রয়েছে। এসব শোরুম থেকে দিনে চার-পাঁচ কোটি টাকার ডায়মন্ড বিক্রি করা হতো। এর বেশির ভাগই নকল বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে।
দিলীপ কুমার আগরওয়ালা দুবাই-সিঙ্গাপুরে সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন জানিয়ে সিআইডি সূত্র বলছে, তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার মাধ্যমে ৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে অবৈধভাবে একটি ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
সিআইডি সূত্র বলছে, দিলীপ কুমার আগরওয়ালার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড বিগত ১৫ বছরে ২৫ হাজার ২০০ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে বলে গোয়েন্দাদের তদন্তে উঠে আসে।
ভ্যাট ফাঁকি ও দিলীপ কুমার আগরওয়ালার আয়কর নথি তদন্ত শুরু করলে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দিলীপ তদন্ত এগোতে দেননি জানিয়ে সিআইডি বলছে, যাঁরা এই কার্যক্রমের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তাঁদের বিভিন্ন জায়গায় বদলি করা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সঙ্গে ছবি তুলে সেগুলো মন্ত্রী, আমলা ও সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পাঠিয়ে ভয়ভীতি দেখাতেন।
এনবিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে সিআইডি জানতে পেরেছে, ঢাকাসহ সারা দেশে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের অন্তত ৩০টি শোরুম থেকে বছরে এক হাজার ৬২০ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছেন দিলীপ। সেই হিসাবে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড গত ১৫ বছরে ২৫ হাজার ২০০ কোটি টাকার ভ্যাট দেয়নি বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ১০ অক্টোবর দিলীপ কুমার আগরওয়ালার বিরুদ্ধে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে একটি অভিযোগে বলা হয়, সোনা ও হীরা চোরাচালানের মাধ্যমে দিলীপ কুমার আগরওয়ালা রাজস্ব ফাঁকিসহ শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন।
অভিযোগের সূত্র ধরে দুদকের পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) দিলীপ কুমার আগরওয়ালার আয়কর নথি ও ভ্যাট ফাঁকির তদন্ত শুরু করে। তবে রহস্যজনক কারণে সেই তদন্ত ধামাচাপা পড়ে আছে।
কয়েক বছর ধরে দেশে কোনো ডায়মন্ড আমদানি হয় না জানিয়ে সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক তদন্তে দিলীপ কুমার আগরওয়ালা ডায়মন্ড আমদানি, নাকি ডায়মন্ডের নামে অন্য কিছু বিক্রি করেন, সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যদি ডায়মন্ড আমদানি করেন, তাহলে ১৫০ শতাংশের বেশি ট্যাক্স দেওয়ার কথা, সেটাও দিয়েছেন কি না তদন্ত করা হচ্ছে।
পুলিশ বলছে, গত ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে শিবচরের সন্ন্যাসীর চর এলাকার হূদয় হোসেন শিহাব নিহতের ঘটনায় শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের দিলীপ কুমার আগরওয়ালাসহ ১৬১ জনের নামে মামলা করা হয়।
তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ সূত্র বলছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সোনা চোরাচালানের রুটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্বে এর আগে খুন হন ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনার। চাঞ্চল্যকর ওই খুনের ঘটনার তদন্তেও বেরিয়ে আসে দিলীপ কুমার আগরওয়ালার নাম। স্পর্শকাতর দুই মামলার আসামি হলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া সোনা চোরাচালান, হীরা প্রতারণা, হুন্ডি বাণিজ্যসহ অজ্ঞাত সূত্রে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক দিলীপ কুমার আগরওয়ালাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয় মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার আটকের পর। পুলিশের কাছে পিয়াসার দেওয়া স্বীকারোক্তিতে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।