প্রকাশিত: জুলাই ১৫, ২০২৪, ১১:২৮ এএম
সরকারি চাকরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-নাতনিরা পাবে?- রোববার (১৪ জুলাই) বিকেলে গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এদিন সন্ধ্যার পর থেকেই ফেসবুকে ছড়াতে থাকে, ‘আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতি-নাতনি’ বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। যার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেকে ‘রাজাকার’ বলে স্লোগান দিয়ে রাতে বিক্ষোভ শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু কেন তারা নিজেদের ‘রাজাকার’ বলছেন এবং এ ধরনের স্লোগান দিচ্ছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও; চলছে তীব্র আলোচনা-সমালোচনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে রোববার রাত সোয়া ১১টার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক কেন্দ্র-টিএসসি প্রাঙ্গণে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। এসময় ‘ছাত্র সমাজ জেগেছে’, ‘তুমি কে আমি কে-রাজাকার রাজাকার’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন তারা। অন্যদিকে, পাল্টা মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে অবস্থান নেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এছাড়া আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল করেন ক্যাম্পাসের আশপাশের বিভিন্ন এলাকায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মধ্যরাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। রোববার রাত ১১টার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্ট এলাকায় বিক্ষোভ নিয়ে জড়ো হতে থাকেন তারা। এ সময় ‘চাইলাম অধিকার, হইলাম রাজাকার’, ‘তুমি কে, আমি কে-রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান শোনা যায়।
কিন্তু আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কেন এ ধরনের স্লোগান দিলেন? সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, মূল আন্দোলনকারীরা অর্থাৎ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে এসব স্লোগান দেয়া হয়নি। ‘রাজাকার’ স্লোগান টেনে এনে পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে অন্য একটি মহল।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে ‘রাজাকার’ স্লোগান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে রাজনীতির মাঠের বাইরেও। বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপেও হচ্ছে সমালোচনা।
ট্রাফিক অ্যালার্ট নামের গ্রুপে একজন লিখেছেন, একটি যৌক্তিক আন্দোলনের পরিসমাপ্তি দেখতে পাচ্ছি!!! অপরিনামদর্শী একটা স্লোগানেই আন্দোলন তার গতিপথ হারালো, নৈতিক ভিত্তিও। কোন ভাষায় প্রতিবাদ করতে হবে আর কোন ভাষা মুখেও আনা যাবে না, এইটুকু মেধা না থাকলে আন্দোলন তার কাঙ্খিত সাফল্য ঘরে তুলতে পারবে না।
তিনি আরও লেখেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা পাবে না তো রাজাকারের নাতি-নাতনিরা পাবে? এখানে তিনি কি আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতি-নাতনি বলেছেন? তবে কেন স্বাঘোষিত মেধাবীরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের ভিন্ন অর্থ বের করে নিজেদের রাজাকার বলে স্লোগান দিচ্ছে?
সবশেষে তিনি লিখেছেন, কোটা সংস্কারের দাবিটি যৌক্তিক। প্রায় সকলেই সেই দাবির পক্ষে। তবে সেই দাবি আদায়ে নিজেদের রাজাকার দাবি করাটা আরও ভয়াবহ রকমের অযৌক্তিক এবং সকল সীমা লঙ্ঘনের পরিচায়ক।
এদিকে ‘রাজাকার’ স্লোগানের বিপরীতে ফেসবুকজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, ‘একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘তোরা যারা রাজাকার এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’সহ নানা স্লোগান। ‘রাজাকার’ স্লোগান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রী-নেতারাও।
সোমবার (১৫ জুলাই) রাত দেড়টার দিকে ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত লেখেন, ‘একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’। এর সঙ্গে ‘তুমি কে? আমি কে? বাঙালি বাঙালি’ স্লোগান লেখা একটি পোস্টারও শেয়ার করেন তিনি।
এর আগে রাত সোয়া ১২টার দিকে দেয়া এক পোস্টে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক লেখেন, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ শে মার্চ ছাত্র শিক্ষকদেরকে গণহত্যা করেছে রাজাকাররা, সেই রাজাকারের পক্ষে রাজাকারের সন্তান বলে শ্লোগান দিতে লজ্জা করে না?
এরপর, ‘তুমি কে? আমি কে? বাঙালি, বাঙালি’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’ স্লোগান লিখে পোস্ট দেন তিনি। শেয়ার করেন এ সংক্রান্ত একটি পোস্টারও। এদিন, সবশেষ রাত সোয়া ১টায় ফেসবুক আরেকটি পোস্ট দেন পলক। লেখেন, ‘একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার, তোরা যারা রাজাকার এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়।’
একই ইস্যুতে সোচ্চার হয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, যারা নিজেদেরকে রাজাকার বলে পরিচয় দেয়, তাদের মুক্তিযুদ্ধের শহীদের রক্তস্নাত লাল সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে বা সে পতাকা কপালে বেঁধে নিয়ে মিছিল করবার কোন অধিকার থাকতে পারে না।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেনও রাজাকারবিরোধী স্লোগান শেয়ার করেছেন ফেসবুকে। পাশাপাশি কর্মীদের নিয়ে বিক্ষোভের লাইভ করেছেন তিনি। রাজাকারবিরোধী স্লোগান ফেসবুকে শেয়ার করেছেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানও।
অন্যদিকে রাজাকারবিরোধী স্লোগানের বিপরীতে ডিফেন্ডিং অ্যাগেইনস্ট অল অডস নামের একটি পেজ থেকে লেখা হয়, ‘তুমি কে আমি কে? বাঙালি! বাঙালি!’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা!’, ‘তোরা যারা রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’ স্লোগান। গো বাংলাদেশ নামের একটি পেজ থেকেও লেখা হয়, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’, ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি’। ‘মুক্তিযুদ্ধ ভুলি নাই রাজাকার তোর ক্ষমা নাই’, স্লোগান লিখে শেয়ার করা হয় আগামীর বাংলাদেশ নামের একটি পেজ থেকে।
এছাড়া বাংলার সমাচার থেকে লেখা হয়েছে, লাখো শহীদ ডাক পাঠালো, সব সাথীরে খবর দে, পুরা বাংলা ঘেরাও করে রাজাকারদের কবর দে’, ‘১৯৭১-এর হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘তোরা যারা রাজাকার এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’ স্লোগান।
তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ গভীর রাতে ফেসবুকে দেয়া এক বার্তায় দাবি করেছেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ‘তুমি নই, আমি নই রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান দিয়েছিলেন। অর্থাৎ আমি কিংবা তুমি কেউই রাজাকার নই।
শিক্ষার্থীরা ‘তুমি কে আমি কে-রাজাকার রাজাকার স্লোগান’ দিয়েছেন বলে এখন গুজব ছড়ানো হচ্ছে বলেও দাবি করেন আসিফ মাহমুদ।