প্রকাশিত: জুলাই ১০, ২০২৪, ১১:৪৪ এএম
বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর নাম বেরিয়ে এলেও পেছনে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটে পিএসসির অন্তত দুজন উপপরিচালক (ডিডি), দুজন সহকারী পরিচালক (এডি) এবং দুজন অফিস সহকারীর সন্ধান পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ওই সিন্ডিকেটে থাকা আরও কয়েক সদস্যের বিষয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছে সংস্থাটি।
সিআইডির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মূলত পিএসসির উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম ও আবু জাফর এবং সহকারী পরিচালক এসএম আলমগীর কবির ও নিখিল চন্দ্র রায় দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছিলেন। তাদের মধ্যে নিখিল চাকরিচ্যুত। তারা নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দুই অফিস সহকারী খলিলুর রহমান ও সাজেদুল ইসলামের মাধ্যমে গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর হাতে তুলে দিতেন।
সিআইডির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, এই আবেদ আলী ১৯৯৭ সালে ভুয়া ঠিকানায় পিএসসিতে গাড়িচালকের চাকরি নেন। এর পাঁচ বছরের মধ্যেই ২০০২ সাল থেকে জড়িয়ে পড়েন প্রশ্নফাঁস চক্রে। প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ পেয়ে ২০১৪ সালে তাকে চাকরিচ্যুত করলেও তিনি পিএসসির ভেতরে থাকা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁস করে যাচ্ছিলেন। তার ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম ফাঁস হওয়া প্রশ্নের বিক্রির দায়িত্বে ছিলেন। তিনি পরীক্ষার্থী খুঁজতেন। সর্বশেষ গত ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত রেলওয়ের ১৫৬টি উপসহকারী প্রকৌশলী পদের নিয়োগ পরীক্ষায় এই চক্রটি প্রশ্নপত্র ফাঁস করে।
পিএসসির নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গত সোমবার রাতে রাজধানীর পল্টন থানায় বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন আইনে সিআইডি ৩১ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৫০-৬০ জনকে আসামি করে মামলা করে। মামলার ১৭ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হলেও এজাহারনামীয় আসামির মধ্যে পিএসপির সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়, শরীফুল ইসলাম ভূঁইয়া, দীপক বণিক, মো. খোরশেদ আলম খোকন, কাজী মো. সুমন, একে এম গোলাম পারভেজ, মেহেদী হাসান খান, মো. গোলাম হামিদুর রহমান, মুহা. মিজানুর রহমান, আতিকুল ইসলাম, এটিএম মোস্তফা, মাহফুজ কালু, আসলাম ও কৌশিক দেবনাথ পলাতক রয়েছে।
গ্রেপ্তার আসামিদের গতকাল মঙ্গলবার আদালতে হাজির করে সিআইডি। তাদের মধ্যে শুনানি শেষে আদালত পিএসসির উপপরিচালক আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির, আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম, গার্মেন্টস ব্যবসায়ী নোমান সিদ্দিকী, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ব্যবসায়ী মো. জাহিদুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার পাসপোর্ট অফিসের অফিস সহকারী মো. মামুনুর রশীদ, ডেভেলপার ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান মো. সোহেল এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিকেল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুন হাসানকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
অন্যদিকে, পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী, অফিস সহকারী খলিলুর রহমান, অফিস সহায়ক (ডেসপাস) সাজেদুল ইসলাম, রাজধানীর পল্টনের পানি ফিল্টার ব্যবসায়ী দুই ভাই সাখাওয়াত হোসেন ও সায়েম হোসেন এবং ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র লিটন সরকার আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে তারা এমন অপকর্মের জন্য অনুতপ্ত বলে জানা গেছে।
ওই মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা সিআইডির সাইবার ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন্স বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এই চক্রটি প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছিল। তারা বিভিন্ন পেশার হলেও কেউ প্রশ্নপত্র ফাঁস করত, কেউ ক্রেতা সংগ্রহ করত, কেউ ফাঁস হওয়া প্রশ্ন বিক্রি ও সরবরাহ করত এবং টাকা আদায় করত। কার কী দায়িত্ব ছিল, তা তদন্ত করে বের করা হচ্ছে।
সিআইডি সূত্র জানায়, মূলত ২০০২ সাল থেকেই গাড়িচালক আবেদ আলীর মাধ্যমে পিএসসিতে থাকা চক্র প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছিল। পিএসসির অধীনে থাকা বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াও কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে বলেও তথ্য রয়েছে। এসব তথ্য যাচাই করা হচ্ছে।
সিআইডির একজন কর্মকর্তা বলেন, ২২ বছর আগে থেকে আবেদ আলী প্রশ্নপত্র ফাঁস করলেও এখন পিএসসিতে তার সিন্ডিকেটে দুই উপপরিচালক ও দুই সহকারী পরিচালকসহ কয়েকজনের নাম বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু এর আগেও পিএসসিতে তার সিন্ডিকেটে এই ধরনের সদস্য ছিল। তারা কারা, সেই অনুসন্ধান চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এক সময়ে আবেদ আলী পিএসসির আলোচিত সদস্য অধ্যাপক মাহফুজুর রহমানের গাড়িচালক ছিলেন। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত একাধিক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল এই আবেদ আলী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। তখন পিএসসির ওই সদস্যের নামও এসেছিল। প্রশ্নফাঁসের টাকার দ্বন্দ্বে ওই সময়ে এক শিক্ষককে প্রাণনাশের হুমকিও দেন আবেদ আলী। ওই ঘটনায় জিডি হয়েছিল তখন। পিএসসির সেই সদস্য এখন কানাডায় বসবাস করেন।
পিএসসির অফিস সহায়ক গ্রেপ্তার সাজেদুল ইসলাম সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, সে মূলত উপপরিচালক আবু জাফরের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র পেত। পরীক্ষার আগের দিন সে হাতে প্রশ্নপত্র পেত। এরপর তা আবেদ আলীর কাছে দেওয়া হতো। আবেদ আলী আগেই পরীক্ষার্থী ঠিক করে রাখত।
সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিক তদন্তে এখন পর্যন্ত গাড়িচালক আবেদ আলী অন্তত অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদের মালিক বলে জানা গেছে। ঢাকায় তার একটি ছয়তলা বাড়ি, তিনটি ফ্ল্যাট ও একটি গাড়ি থাকার তথ্য রয়েছে। গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের ডাসারে রয়েছে ডুপ্লেক্স ভবন। আবেদ আলীর আরও সম্পদ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনেও মামলা করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, আবেদ আলী মিরপুরের পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ওয়াসা রোডে বিসমিল্লাহ টাওয়ার নামে একটি ৯ তলা ভবনের পঞ্চমতলার ফ্ল্যাটে দুই ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে থাকতেন। ভবনটিতে তার অন্তত পাঁচটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া পাইকপাড়ায় তার একটি ছয়তলা বাড়ি রয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকে তার নগদ টাকা গচ্ছিত রয়েছে।
সিআইডি সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া পিএসসির দুই উপপরিচালকসহ অন্যদের সম্পদের বিষয়ে তথ্য নেওয়া শুরু হয়েছে। তারাও অস্বাভাবিক সম্পদের মালিক হয়েছেন। এরই মধ্যে তাদের দামি গাড়ি, রাজধানীর অভিজাত এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক স্পেসের সন্ধান মিলেছে। তারা সরকারি চাকরি করলেও গত তিন মাসে তাদের ব্যাংক হিসাবে অন্তত ২৫ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এরই মধ্যে কয়েকজনের ডজনখানেক ব্যাংক হিসাবের নথি জব্দ করা হয়েছে।