প্রকাশিত: মে ২৪, ২০২৪, ১০:৩৯ এএম
বাজেটে সুবিধা পাওয়ার দিক থেকে সরকারি চাকরিজীবীরা সরাসরি সম্পৃক্ত হলেও প্রত্যক্ষ সুবিধার দিক থেকে বিচ্ছিন্ন বেসরকারি চাকরিজীবীরা। বছরের পর বছর বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে বেসরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে নেই বাজেট নিয়ে কোনো উত্তেজনা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, দেশে ৭ কোটির বেশি মানুষ চাকরি এবং কর্মমুখী নানা ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত। এই বিশাল সংখ্যক মানুষের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা মাত্র সাড়ে ১৫ লাখ, যা মোট কর্মক্ষম মানুষের ১ শতাংশের মতো।
প্রতি অর্থবছরের বাজেট থেকে সরকারি চাকরিজীবীরা সরাসরি নানা সুবিধা পেয়ে থাকলেও বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন বেসরকারি চাকরিজীবীরা। বেতন বৃদ্ধি কিংবা আবাসন সুবিধা, কোনো দিক থেকেই সুফল পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ জানিয়েছেন তারা।
একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী হালিমা আক্তার বলেন, বাজেট নিয়ে সরকারি চাকরিজীবীরা ভাবেন তাদের বেতন বাড়বে কিনা, আবাসন সুবিধার স্বরূপ কী হবে। অন্যদিকে বেসরকারি চাকরিজীবীরা ভাবেন কোন কোন জিনিসের দাম বাড়বে। পণ্যের দাম বাড়লে বাড়ি ভাড়া বাড়বে। এসবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাড়বে না বেতন। যারা বেসরকারি চাকরি করে তাদের কাছে বাজেট মানে কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
বেসরকারি একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শামীম আহমেদ বলেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের আবাসন সুবিধা সাড়ে ৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। তাদের সাড়ে ৬ হাজার ফ্ল্যাট বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি জেলায় সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ডরমেটরির স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর বিপরীতে বেসরকারি চাকরিজীবীদের অবস্থা এমন হয়েছে, তারা সব ধরনের সরাসরি সরকারি সুবিধা ও বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত।
পনেরো বছরে ধরে একটি বেসরকারি ফার্মে চাকরি করেন মনোয়ার হোসেন। সময় সংবাদকে তিনি বলেন, চাকরির শেষ সময় এসে ভেবেছিলাম একটি ফ্ল্যাট কিনবো। কিন্তু প্রতিবার বাজেট এলেই ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে রড-সিমেন্টের দাম। বাজেট মানেই বেসরকারি চাকরিজীবীদের ওপর বাড়তি চাপ। বাজেট বরাদ্দ সুবিধার দিকে ইঙ্গিত না করে উল্টো সমাজে চলমান বৈষম্যের দিকে ইঙ্গিত করে।
সমাজের বড় একটি অংশ বাজেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারছে না। বাজেট এলেই তাদের মানসিক চাপও বাড়ে। সমাজে এর প্রভাব প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী আনোয়ার হোসেন বলেন, মানুষ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ আয়-ব্যয়ের এ হিসাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে না পারলে তাদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিয়ে এক রকমের উদাসীনতা কাজ করে। তারা কর প্রদানকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব না ভেবে রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া বোঝা হিসেবে মনে করে।
আনোয়ার বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের বাজেটে সুবিধা দেয়ার মধ্যে ততক্ষণ দোষের কিছু নেই যতক্ষণ এই সুযোগ-সুবিধা বেসরকারি চাকরিজীবীদের প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বৈষম্যের মাত্রা যদি আকাশ-পাতাল হয় তাহলে সমাজের সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে ভাবতে শুরু করেন।
বেসরকারি চাকরিজীবী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষকে কীভাবে বাজেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায় এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক অতনু রব্বানী বলেন, সরকার হয়তো চাইলেই বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়িয়ে দিতে পারবে না। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, চিকিৎসা সেবা এবং শিক্ষা ব্যয় কমিয়ে এদেরকে বাজেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা সম্ভব।
অতনু রব্বানী আরও বলেন, শিক্ষার কথাই যদি বলা হয়, এটি মানুষের সার্বজনীন বৈষম্যহীন অধিকার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভালো শিক্ষা পাওয়ার জন্য অভিভাবকরা সন্তানদের প্রাইভেট স্কুলে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন। স্কুলের পাশাপাশি কোচিংয়ে দিচ্ছেন। এতে করে শিক্ষার পেছনে তাদের অনেক টাকা ব্যয় হচ্ছে। এই ব্যয় কমিয়ে আনতে পারলে বাজেট অনেক বেশি জনবান্ধব হবে এবং মানুষ বাজেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারবে।
একইভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা ব্যয় কমিয়ে আনার মাধ্যমেও সাধারণ মানুষকে বাজেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায় বলে অভিমত প্রকাশ করেন এ অর্থনীতিবিদ।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের তরুণ ও নারীদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে সরকার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে তরুণদের জ্ঞানভিত্তিক, দক্ষ ও উপযুক্ত কর্মশক্তিতে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা করবে বলে সেসময়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন তৎকালীন অর্থ প্রতিমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
তবে চলতি অর্থবছরে শেষ পর্যায়ে এসে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান জানিয়েছেন, নারী ও তরুণদের জন্য বরাদ্দ করা এ অর্থ থেকে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো খরচ হয়নি।
তিনি বলেন, প্রতি বছর বাজেটে ১০০ কোটি টাকা রাখা হয় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য, সেটা ব্যবহার হয় না। উদ্যোক্তারা যদি আরও তৎপর হন, তাহলে তাদের ব্যবসার অর্থায়নের যথেষ্ট সুযোগ আছে। আমরা স্মার্ট ফাইন্যান্সিং করছি। পাঁচ বছর পর ব্যবসা কোথায় নেবেন, সে বিষয়ে পরিকল্পনা থাকতে হবে। সরকারের দেয়া সুযোগগুলো কাজে লাগাতে হবে।
নারী, তরুণ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে বরাদ্দ করা অর্থ খরচ না হওয়া এবং এটিকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে বরাদ্দ না বাড়ানো প্রসঙ্গে অতনু রব্বানী বলেন, শুধু বরাদ্দ দিলে হবে না, বরাদ্দ ব্যবহারের সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। সক্ষমতা গড়ে না তুলে বরাদ্দ দিয়ে লাভ হয় না এমন কথা খোঁড়া যুক্তি ছাড়া আর কিছু না।
সাধারণ মানুষের মধ্যে বাজেট নিয়ে চলমান উদাসীনতা এবং অসম্পৃক্ততা বাজেটকে জনবান্ধব না করে এক কেন্দ্রিক করে ফেলবে। এতে করে দিনকে দিন বাজেট বাস্তবায়নের জায়গা থেকে সরে গিয়ে নিছক নথি ও নামকাওয়াস্তে নিয়মানুবর্তিতায় রূপ নেবে বলে জানান অর্থনীতিবিদরা।