বিশেষ প্রতিনিধি
দেশে অগ্নিকাণ্ড যেন নিত্যনৈমত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রতিবছরই ঝরছে শত শত প্রাণ। তবে বড় বড় ঘটনাগুলো ঘটে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলায়। ২০১০ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত বহু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য সাতটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছেন ৪২৫ জন।
গত ১১ বছরে এসব ঘটনায় শুধু তদন্ত কমিটি গঠন ও প্রতিবেদনে সীমাবদ্ধ থাকে প্রশাসন। তবে কিছু কিছু দায়ী ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে নেয়া হয় ছোটখাট ব্যবস্থা। কিন্তু কোনোভাবেই থামছে না এমন দুর্ঘটনা। আগুন থেকে বাঁচতে নেয়া হচ্ছে না স্থায়ী কোনো উদ্যোগ। কেবল তদন্তেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা।
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, দেশের আট বিভাগের মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। আর সবচেয়ে কম অগ্নিকাণ্ড হয় সিলেট বিভাগে। এর কারণ সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস বলছে, অন্য বিভাগীয় শহরের তুলনায় ঢাকার আয়তন, বয়স, ভবন ও মানুষের সংখ্যা, কারখানা সবই বেশি। তাই ঢাকায় ঝুঁকি ও দুর্ঘটনার হার বেশি।
অগ্নিকাণ্ডের পর সূত্রপাত সম্পর্কেও তদন্ত করে ফায়ার সার্ভিস। এসব তদন্তে দেখা গেছে, বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণেই বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। অনেকে বিল্ডিং কোড না মেনেই ভবন নির্মাণ করেন। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাও নেন না। এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সব ক্ষেত্রেই নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকতে হবে। যাতে অগ্নিকাণ্ডের সময় অন্তত ১০-১৫ মিনিটে প্রতিরোধ করা যায়।
সাতটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিচে তুলে ধরা হলো-
১. নিমতলী ট্র্যাজেডি : নিমতলী ট্র্যাজেডির কথা কেউ ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীর নবাব কাটরায় রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গুদামে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। ঘটনায় নিহত হন ১২৪ জন। সেদিন আগুন লাগা নিমতলীর ৪৩ নম্বর বাড়ির নিচতলায় চলছিল বিয়ের আয়োজন। পাশেই ছিল কেমিক্যালের গুদাম। বিস্ফোরণের পর মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
এ ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি তখন বলেছিল, পাশে থাকা বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ থেকেই ছড়িয়ে পড়ে আগুন। এরপর তখন শহরের ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে কথা হলেও সমস্যার সমাধান এখনও হয়নি। বিদ্যুৎ সঞ্চালনব্যবস্থা মাটির নিচে নেয়ার উদ্যোগ এখনও আছে পরীক্ষামূলক অবস্থায়।
২. তাজরীন ফ্যাশন : তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠান তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। সে ঘটনায় ১১১ জন নিহত হন। সাবারের আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় অবস্থিত এ কারখানায় ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডে নয়তলা ভবনের ছয়তলা ভস্মীভূত হয়ে যায়। এতে সরাসরি আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান ১০১ জন পোশাকশ্রমিক। সেদিন আগুন থেকে বাঁচতে উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে মৃত্যু হয় আরও ১০ জনের।
তখন তদন্তে জানা যায়, ওই কারখানায় আগুন দেয়া হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ ফ্যাক্টরির সব দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, যাতে শ্রমিকরা বের হতে না পারে।
৩. টঙ্গী সিগারেট কারখানা : গাজীপুরের টঙ্গীতে ট্যাম্পাকো নামের একটি সিগারেট তৈরির কারখানায় ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ঘটনায় প্রাণ হারান ৪১ জন। বয়লার বিস্ফোরণে ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই কারখানার ভবনের নিচে ছিল রাসায়নিক গুদাম। ফলে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়েছিল আগুন।
ওই কারখানার মালিক সিলেট-৬ আসনের সাবেক এমপি সৈয়দ মকবুল হোসেন। ঘটনায় তিনি বলেছিলেন, বয়লারে কোনো ত্রুটি ছিল কিনা তিনি জানেন না। শেষ কবে বয়লার পরীক্ষা করা হয়েছে, তাও জানেন না তিনি।
৪. চকবাজারের চুড়িহাট্টা : রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। রাত পৌনে ১১টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। সেখানে তখন একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। অগ্নিকাণ্ডে ৭৮ জন নিহত হন। আহত হন অনেকেই।
সেখানে গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণই ছিল প্রধান কারণ। ওই এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে ছিল দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের গুদাম। ফলে বিস্ফোরণ বেড়ে গলি আগুনের নদীতে পরিণত হয় ৷ সেই অগ্নিকাণ্ডে ৭৮ জন মানুষ প্রাণ হারালেও এখনও রয়ে গেছে রাসায়নিকের গুদাম। পুরান ঢাকার বাইরে রাসায়নিক গুদাম নিয়ে যাওয়ার সরকারি উদ্যোগ এগোচ্ছে ধীরগতিতে।
৫. বনানী এফআর টাওয়ার : ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারে। সেখানে দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটের দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এতে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন প্রায় ৭০ জন। ফায়ার সার্ভিস, সেনা, নৌ, বিমান এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ৬ ঘণ্টা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
সেই ভবনে অগ্নিকাণ্ডের সময় দ্রুত বের হওয়ার বিকল্প কোনো সিঁড়িই ছিল না। অনেকেই তাই কাঁচের দেয়াল ভেঙে লাফিয়ে পড়ে আহত ও নিহত হন। তবে এই ভবন নিয়ে বড় অভিযোগ হলো নকশা লঙ্ঘন। এফ আর টাওয়ার রাজউক থেকে ১৮ তলার নকশার অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা করা হয়। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরে নকশার এই অনিয়ম নিয়ে মামলা হয়। যা এখনও চলছে।
৬. নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় মসজিদে বিস্ফোরণ : ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি মসজিদে বিস্ফোরণ ঘটে। মসজিদে তখন লোকজন ছিল, তারা এশার নামাজ পড়ছিল। বিস্ফোরণে মসজিদে থাকা ৩৪ জনের মৃত্যু হয়। সেদিন দগ্ধ হয় আরও ১৫ জন।
তদন্ত সংস্থা সিআইডি বিস্ফোরণের কারণ উদঘাটন করে। তারা জানায়, মসজিদের ভেতরে বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ ছিল। গ্যাসের সংযোগও ছিল অবৈধ। বিদ্যুতের স্পার্ক যেয়ে পড়েছে গ্যাস লাইনের লিকেজ দিয়ে বের হয়ে আসা গ্যাসের ওপর, আর তাতেই বিস্ফোরণ ঘটে।
৭. মগবাজারে বিস্ফোরণ : রাজধানীর মগবাজারে এ বছরের ২৭ জুন গ্যাস বিস্ফোরণে ১১ জনের যে প্রাণহানি ঘটে। সেখানে গ্যাস লাইনের ত্রুটির বিষয়টি সামনে এসেছে। আবার বর্জ্য জমে মিথেন গ্যাস তৈরির সম্ভাব্য কারণের কথাও বলা হচ্ছে।
সম্রাট/টিআর/নির্জন
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন