• ঢাকা শুক্রবার
    ০৮ নভেম্বর, ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

কোনো কেন্দ্রে শূন্যভোট কোথাও ৮০-৯০ ভাগ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১২, ২০২৪, ১০:১৭ এএম

কোনো কেন্দ্রে শূন্যভোট কোথাও ৮০-৯০ ভাগ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খাগড়াছড়ি আসনের ১৯টি ভোটকেন্দ্রে একটিও ভোট পড়েনি। এ আসনের অন্য ৪০টি ভোটকেন্দ্রে ৭০ থেকে ৯১.২ শতাংশ ভোট পড়েছে। একইভাবে রাঙামাটি আসনের ৮টিতে কোনো ভোটই পড়েনি। তবে ৫১টি কেন্দ্রে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। শুধু রাঙামাটি বা খাগড়াছড়িই নয়, দেশের অনেক আসনেই কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোট পড়ার হারে বড় ব্যবধান পাওয়া গেছে। একই আসনের কিছু কেন্দ্রে ১০ শতাংশের নিচে ভোট পড়লেও কিছু কেন্দ্রে ৮০ বা ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম ও গাইবান্ধার দুটি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। একই আসনে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোট পড়ার হারে এত বড় পার্থক্য অস্বাভাবিক বলছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নির্বাচন কমিশনই একেক সময় ভোট পড়ার হার নিয়ে একেক ধরনের তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফল বৃহস্পতিবার বিকালে ইসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণের চার দিনের মাথায় এ ফল প্রকাশ করা হলো। প্রকাশিত বেশ কিছু আসনের ফল বিশ্লেষণে ভোট পড়ার হারের এই পার্থক্য দেখা গেছে।

তবে নির্বাচনের পরদিনই ভোটের হার নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছোড়েন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ। আর ভোটের এই হার নিয়ে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে চাইলে কমিশন প্রস্তুত রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোট পড়ার এই ব্যবধান অস্বাভাবিক। নির্বাচনের ফলাফল ইসিই বিতর্কিত করেছে। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর সিইসি নির্বাচনে ২৮ শতাংশ ভোট পড়েছে জানানোর পর তাকে পাশ থেকে শুধরিয়ে ৪০ শতাংশ ভোট পড়ার কথা বলা হয়। সিইসিও ওই ঘোষণা দেন। শেষ এক ঘণ্টায় ১৪-১৫ শতাংশ ভোট পড়ার বিষয়টি বিশ্বাস করা দুরূহ। তিনি বলেন, শেষ মুহূর্তের ভোট পড়ার হারই বুঝিয়ে দিচ্ছে অনেক কেন্দ্রে বেশি ভোট দেখানো হয়েছে। এ নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দল অংশ না নেওয়ায় তাদের এজেন্ট ভোটকেন্দ্রে ছিল না। ফলে কত সংখ্যক ভোট পড়েছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। ভোটগ্রহণ চলার সময় রোববার তিন দফা ভোটের শতকরা হার ঘোষণা করে ইসি। সেই হিসাব অনুযায়ী, দুপুর ১২টা ১০ মিনিট পর্যন্ত গড়ে সাড়ে ১৮ শতাংশ ভোট পড়ে। এরপর বেলা তিনটা পর্যন্ত ২৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ ভোট পড়ার কথা জানায়। বিকাল চারটায় ভোট শেষ হওয়ার ঘণ্টা দেড়েক পর প্রেস ব্রিফিংয়ে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল শুরুতে বলেন, ভোট পড়েছে ২৮ শতাংশ। পরে তাকে পাশ থেকে একজন সংশোধন করে বলেন, সংখ্যাটি ৪০ শতাংশ হবে। সিইসি তখন ভোটের হার ৪০ শতাংশ হতে পারে বলে জানান। তিনি বলেন, এটা নিশ্চিত হিসাব নয়। বাড়তে পারে, নাও পারে। এই হিসাব অনুযায়ী ভোটগ্রহণের শেষ এক ঘণ্টাতেই ১৩ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। ভোটের পরদিন সোমবার ইসি প্রায় ৪২ শতাংশ ভোট পড়ার কথা জানায়।

খাগড়াছড়িতে ১৯ কেন্দ্রে একটিও ভোট পড়েনি : খাগড়াছড়িতে কেন্দ্রভেদে ভোট পড়ার হারে বড় ব্যবধান পাওয়া গেছে। এ আসনের ১৯৬টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ১৯টিতে একটি করেও ভোট পড়েনি। আরও ছয়টি কেন্দ্রে সবমিলিয়ে ১৮টি ভোট পড়েছে। অর্থাৎ গড়ে এই ১৮ কেন্দ্রে ভোট পড়েছে একটি করে। অপরদিকে ৪০টি ভোটকেন্দ্রে ৭০ থেকে সর্বোচ্চ ৯১.২ শতাংশ ভোট পড়েছে। কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোট পড়ার এই বড় ব্যবধানের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ২২ হাজার ৮৭৬ ভোট পেয়ে এ আসনের সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির মিথিলা রোয়াজা ১০ হাজার ৯৩৮ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন। ৫১৫৪১৯টি ভোটের মধ্যে ২৫৭৬৫৪টি ভোট পড়েছে। ভোট পড়ার গড় হার ৪৯.৯৯ শতাংশ।

এ আসনের যে ১৯টি ভোটকেন্দ্রে একটি করেও ভোট পড়েনি, সেই কেন্দ্রগুলোতে ভোটার ছিলেন ৩৬ হাজার ৪০২ জন। নির্বাচন কমিশনের ভোটকেন্দ্রের তালিকায় ওই কেন্দ্রগুলোর ক্রমিক হচ্ছে-৩, ৪, ১৫, ৬৬-৬৯, ৭৬, ১৫৭-১৬১, ১৬৭, ১৬৮, ১৬৯, ১৭১, ১৭২ ও ১৮০। এছাড়া ছয়টি ভোটকেন্দ্রে সবমিলিয়ে ভোট পড়েছে ১৮টি। ওই ছয় কেন্দ্রে ভোটার ছিলেন ১৮৮৪৮ জন। এর মধ্যে উদাল বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২৬৭৫ জন ভোটার থাকলেও ভোট পড়েছে মাত্র একটি। দক্ষিণ লতিবান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ২১৮৪ ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন মাত্র একজন। এছাড়া দুটি কেন্দ্রে তিনটি করে, একটিতে চারটি ও একটিতে ছয়টি ভোট পড়েছে। অপরদিকে ৪০ ভোটকেন্দ্রে ৭০ থেকে ৯১.২ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়েছে। এর মধ্যে ১২টি কেন্দ্রে ভোট পড়ার হার ৮০ শতাংশের বেশি।

রাঙামাটিতে ৮টিতে ভোট পড়েনি, ৫১টি কেন্দ্রে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট : রাঙামাটিতে ৮টি ভোটকেন্দ্রে একটিও ভোট পড়েনি। এর বাইরে আরও আটটি ভোটকেন্দ্রের কোনোটিতে ৩টি, কোনোটিতে ৬টি আবার কোনোটিতে ১৮টি ভোট পড়েছে। এই আটটি কেন্দ্রে ১৬৬৭০ জন ভোটারের মধ্যে ভোট পড়েছে ৬৮টি; যার ৫২টি ভোট পেয়েছেন আওয়ামী লীগের দীপংকর তালুকদার। ওইসব কেন্দ্রে ভোটার ছিলেন ১৫৮৩৯ জন। পক্ষান্তরে ৫১টি ভোটকেন্দ্রে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। এই ৫১টি আসনে ১০৮২৪১টি বৈধ ভোটের মধ্যে ১০৬৫৫০টিই পেয়েছেন আওয়ামী লীগের দীপংকর তালুকদার। তিনি এ আসনে ২৭১৩৭৩ ভোট পেয়ে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রার্থী অমর কুমার দে মাত্র ৪৯৬৫ ভোট পেয়েছেন। আসনটির ৪৭৪৪৫৪টি ভোটের মধ্যে পড়েছে ২৮২৭৭৭টি। ভোট পড়ার হার ৫৯.৬০ শতাংশ।

কেন্দ্রে কেন্দ্রে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট : বেশ কয়েকটি আসনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সিরাজগঞ্জ-১ আসনে ১৭৩টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৬৪টি কেন্দ্রে ৮০ শতাংশ বা তার বেশি হারে ভোট পড়েছে। অপরদিকে তিনটি কেন্দ্রে ৩০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে। এ আসনে আওয়ামী লীগের তানবির সাকিল জয় বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী বাকি তিন প্রার্থীর কেউ জামানত রক্ষা করতে পারেননি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনের ৯১টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩০টিতেই ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। বাকি ৬১টি কেন্দ্রের মধ্যে ৬০টিতে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে। বাকি একটিতে ৪৭.৪৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। এ আসনে আওয়ামী লীগের ক্যাপ্টেন (অব.) এবি তাজুল ইসলাম ১৯৩৮৭০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। এখানে ভোট পড়ার হার ৭৬ শতাংশ। একইভাবে অনেক আসনেই বিপুলসংখ্যক কেন্দ্রে ৮০ শতাংশের ওপরে ভোট পড়েছে।

নির্বাচনসংশ্লিষ্ট অনেকে বলেন, শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিপরীতে অন্য প্রার্থীদের এজেন্ট বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিলেন না। এজেন্ট না থাকার কারণেও অনেক জায়গায় জয়ী প্রার্থীদের পক্ষে বেশি ভোট দেওয়া হয়েছে।

একই আসনে কেন্দ্রভেদে ভোটের বড় ব্যবধান : নির্বাচনে একই আসনে কেন্দ্রভেদে ভোট পড়ার হারে বড় ব্যবধান পাওয়া গেছে। কক্সবাজার-১ আসনে জয়ী হয়েছেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। এ আসনের ৩৬টি ভোটকেন্দ্রের প্রতিটিতে ২০ শতাংশের নিচে ভোট পড়েছে। অপরদিকে দুটিতে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে।

ঢাকা-১ আসনের ১৮৪টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৪টির প্রতিটিতে ২৫ শতাংশের নিচে ভোট পড়েছে। এর বিপরীতে ২০টি কেন্দ্রে ৫০ শতাংশ বা তার বেশি ভোট পড়েছে। এ আসনে ৫১৩৬০৯ জন ভোটারের মধ্যে পড়েছে ১৯০৯৯১ ভোট। এর মধ্যে একাই এক লাখ ৫০ হাজার ৫ ভোট পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সালমান ফজলুর রহমান।

সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল অভিনব। গণতান্ত্রিক দেশে ভোট পড়ার হারে সাধারণত এত বড় পার্থক্য থাকে না।

দুই কেন্দ্রে শতভাগ ভোট : চট্টগ্রাম-৩ আসনের মমতাজুল উলুম মাদ্রাসা ও গাইবান্ধা-৪ আসনের শিবপুর ফজরিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ওই কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩৯৮০ জন। ভোট বাতিল হয়েছে ২৩৫৭টি। গাইবান্ধার কেন্দ্রে মোট ভোটার ২৪৫০। বাতিল হয়েছে ৬৬২টি। ইসির প্রকাশিত ফলাফলে এই তথ্য দেখানো হয়েছে।

 

আর্কাইভ