• ঢাকা রবিবার
    ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ

সরকারের এখন যত চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০২৩, ০৬:১৫ পিএম

সরকারের এখন যত চ্যালেঞ্জ

ছবি: সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

রাজনীতির পাশাপাশি নানামুখী সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। এর মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপিসহ বেশ কিছু দল দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনে থাকলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই হতে যাচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। তবে নির্বাচনকালে বর্তমান সরকারকে বেশ কিছু চালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী হয়ে টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য আগামী দিনেও আওয়ামী লীগকে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের সামনে সাতটি চ্যালেঞ্জের কথা বলছেন অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের পর্যবেক্ষণে উঠে আসা এই চ্যালেঞ্জগুলো হলো বিদ্যমান দুর্বল সামষ্টিক অর্থনীতি আর দুর্বল হতে না দেওয়া, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে প্রভাবমুক্ত রাখা, জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে বিদেশিদের মন রক্ষা, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রমুখী করা, চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা ও গণগ্রেপ্তারের প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা, শ্রমিক অসন্তোষের সন্তোষজনক নিরসন এবং দ্রব্যমূল্য আর বাড়তে না দেওয়া।

বিশ্লেষকরা দাবি করছেন, এই চ্যালেঞ্জগুলোর ক্ষেত্র ভিন্ন হলেও সব কয়টির সঙ্গেই আগামী জাতীয় নির্বাচনের রয়েছে প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা। এর কোনো কোনোটিতে জোর দিয়ে বাকিগুলোর উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। অর্থাৎ নির্বাচনকালে দায়িত্বরত এই সরকারকে শুধু নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা করলেই হবে না, সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গভীরভাবে মনোনিবেশে ও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। নতুবা পরবর্তী সরকার ও দেশকে এর জের টানতে হতে পারে।

নির্বাচনকালে সরকারের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সিটি নিউজ ঢাকাকে বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকারকে নির্বাচনমুখী হওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতির বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোও সমানতালে মোকাবিলা করে যেতে হবে। বিশেষ করে উচ্চহারের মূল্যস্ফীতি, ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভের অবনতি, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়হারের বেজায় অস্থিতিশীলতা, ব্যাংকিং খাতে নন-পারফর্মিং ঋণের মাত্রা ক্রমশ বেড়ে যাওয়া এবং বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির ক্রমাবনতি রুখতে এই সময়ও কঠোর মনোযোগ রাখতে হবে। নতুবা অর্থনীতির আরও নাজুক অবস্থা তৈরি হবে। যার খেসারত পরবর্তী সরকারকে দিতে হবে।’

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ সিটি নিউজ ঢাকাকে বলেন, ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করাই নির্বাচনকালীন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। যেটা হবে প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত এবং জনগণ যাকে ভোট দেবে, ফলাফলে যেন তার প্রতিফলন ঘটে। যদিও সরকার এবারকার নির্বাচন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে সুষ্ঠু হবে—এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছে। এই কথা ও কাজে মিল রাখাই হবে নির্বাচনকালীন সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।’

নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সবাই এলে নির্বাচন পরিপূর্ণ হয়। তবে শেষ পর্যন্ত কতটা অংশগ্রহণমূলক হলো, সেটি সরকার, বিশ্ব সম্প্রদায় কিংবা জনগণের কাছে বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত নয়। কারণ কেউ না চাইলে তো জোর করে অংশগ্রহণ করানো যাবে না। কিন্তু আমার ভোটটি যাতে আমি দিতে পারি, একইভাবে আমি যাকে ভোট দেব তার কাছে যাতে সেটি জমা হয়, অর্থাৎ সেখানে যাতে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করে উল্টে দেওয়া না হয়—সেটিই সবার কাছে বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি, যার নিশ্চয়তা দেওয়া এই নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব।’

এদিকে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি অনেকদিন ধরেই সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত মূল্যস্ফীতির চিত্রেও এর প্রমাণ মেলে বাংলাদেশে। গত অক্টোবর মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ ছাড়া গত তিন মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের ওপরে। অর্থাৎ খাদ্য মূল্যস্ফীতির লাগাম কিছুতেই টেনে ধরা যাচ্ছে না। এর অর্থ হচ্ছে, বেঁচে থাকার জন্য শুধু খাদ্য কিনতেই সীমিত আয়ের মানুষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এই পরিস্থিতি ক্ষমতাসীনদের ভোটের প্রচারে অস্বস্তির কারণ হতে পারে বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ। তিনি বলেন, ‘শুধু নির্বাচন করলেই হবে না। জিততে হলে জনগণের রায়ও অর্জন করতে হবে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির কারণে মূল্যস্ফীতি অসহনীয় হয়ে উঠছে। এ নিয়ে জনজীবনে দুর্যোগ-দুর্ভোগ আছে। মানুষের মধ্যে অসন্তোষ আছে। তাই যে কোনোভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যাতে মানুষের কাছে সহনশীল রাখা যায়, অন্তত ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের সুফল ঘরে তোলাও এই সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। আর জনমালের নিরাপত্তা দেওয়া যে কোনো সরকারের রুটিন দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। যদিও এই সময় বাড়তি চাপ থাকে, যার প্রস্তুতি এখন থেকেই রাখতে হবে।’

ওদিকে চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছে ৪৭টি দেশের প্রতিনিধিত্বকারী জোট জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউ (ইউপিআর) ওয়ার্কিং গ্রুপ। যেখানে বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী ও বিক্ষোভকারীদের নির্বিচারে গ্রেপ্তারের বিষয়টি ছাড়াও গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে মৃত্যুসহ নানা দিক আলোচনায় উঠে আসে। এ ছাড়া শ্রম অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, লিঙ্গ সমতা এবং মানব পাচারের বিষয়গুলোও স্থান পেয়েছে। এরই মধ্যে আবার গত শুক্রবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের শ্রম অধিকার ও মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নে ভিসা নীতি ও নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন।

এই বৈশ্বিক চাপ সরকার কীভাবে মোকাবিলা করবে—জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হারুন অর রশিদ জানান, ‘আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন নির্বাচনকালীন সরকারের পক্ষে রাখা একটি চ্যালেঞ্জ। তবে পর্দার অন্তরালের চিত্র ভিন্ন। কারণ, ভূ-রাজনীতিতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চেয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলোর স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতাই বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। তাই ফিলিস্তিনে গণহত্যা চললেও সেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নির্বিকার। এটা সবাইকে বুঝতে হবে। আমি মনে করি, বাংলাদেশের মানবাধিকার আর নির্বাচন নিয়ে কখনোই যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বড় মাথাব্যথা ছিল না, এখনো নেই। যেটুকু হচ্ছে, সেটি হলো নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিজস্ব সংশ্লিষ্টসহ আরও ভূ-রাজনৈতিক কারণ, যা নির্বাচনকালীন সরকারের কাছে মুখ্য বিষয় না হওয়াই ভালো।’

অন্যদিকে নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। তাই এই কমিশনকে নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার মানসিকতা সুদৃঢ় রাখাই হবে নির্বাচনকালীন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। এমন মন্তব্য করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি নিউজ ঢাকাকে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র বা সরকারের প্রথম দায়িত্বই হলো ল’ অ্যান্ড অর্ডার এনফোর্সমেন্ট করা। কন্ট্রোল করা। যাতে নির্বাচনকালীন সময়ে দেশের জনগণ নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শঙ্কাবোধ না করে। একই সঙ্গে নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর জনগণের কনফিডেন্স ফিরিয়ে আনাও এই সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।’

 

সিটি নিউজ ঢাকার ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন

 

জেকেএস/

আর্কাইভ