প্রকাশিত: আগস্ট ২১, ২০২৩, ০৩:৪০ এএম
২০২৩ সালের শেষ কিংবা ২০২৪ সালের শুরুতে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এর আগে দেশটির রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে অস্থিরতা বিরাজ করছে । এই অবস্থায় ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম ফ্রন্ট লাইন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, নির্বাচনে যদি শেখ হাসিনার দল হেরে যায় তাহলে বাংলাদেশ দীর্ঘ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার সম্মুখীন হতে পারে।
শেখ হাসিনার সরকার ভারতের সবচেয়ে কাছের এবং একমাত্র নির্ভরযোগ্য অংশীদার। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসায় যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া রাজনৈতিক সংকট থেকে বাংলাদেশকে মুক্তি দেওয়ার জন্য চাপ বাড়ছে ভারতের ওপর। যদিও ভারত ঐতিহ্যগতভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় ‘বড় শক্তি’ হিসেবে স্বীকৃত। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেই অবস্থানটিকে চ্যালেঞ্জ করে আসছে চীন।
বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এক ধরণের পরোক্ষ চাপ আসছে। এরইমধ্যে যারা নির্বাচনী কারচুপিতে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। পাশাপাশি, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
২০০৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারসাজি এবং বিরোধী রাজনীতিকদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে শেখ হাসিনা বরাবরই বলে আসছেন, বাংলাদেশে নির্বাচন সবসময়ই অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে।
তারপরও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মিত্র দেশগুলো শেখ হাসিনার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আসছে। সম্প্রতি ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের সময় বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেসময় আওয়ামী লীগ সমর্থকরা স্বতন্ত্র এক প্রার্থীর ওপর হামলা করলে তার সমালোচনা করে বিবৃতি দেন ইইউসহ বেশ কয়েকটি দেশের কূটনীতিকরা।
মার্কিন চাপ বিরোধীদের চাঙ্গা করছে
বাংলাদেশের রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ হস্তক্ষেপ সরকার বিরোধীদের চাঙ্গা করেছে। প্রধান বিরোধী দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এতে উচ্ছ্বসিত এবং সরকারকে আক্রমণ করে সমাবেশ ও সভা করছে। অন্যান্য সংগঠন যেমন জামায়াতে ইসলামী যারা পাকিস্তানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে আসছে এবং দেশের মুক্তি সংগ্রামের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল, তারাও মার্কিন অবস্থানের কারণে রাজনীতিতে উৎসাহী হয়ে উঠছে।
ভারতের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র
প্রায় এক দশক ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং শেখ হাসিনার সরকারের মধ্যে একটি আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কমেছে দু’দেশের সীমান্ত সন্ত্রাস। দু’দেশের জনগণও এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে বিজেপি নেতাদের মুসলিম-বিদ্বেষী মনোভাব মাঝেমধ্যে বাংলাদেশ সরকারকে বিব্রতকার অবস্থায় ফেললেও শেখ হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ভারত-বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব বাণিজ্য ও বিনিয়োগ থেকে শুরু করে দু’দেশের উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে ভারত অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু কয়েক দশক ধরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সেই উজ্জ্বলতা অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের একাধিক শাসনব্যবস্থা সক্রিয়ভাবে ভারতবিরোধী শক্তিকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ করতে উৎসাহিত করেছে। ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা দুদেশের সম্পর্ক স্থিতিশীল করেন এবং দেশ থেকে ভারতবিরোধীদের তাড়িয়ে দেন। তবে নয়াদিল্লি এবং ঢাকা আশঙ্কা করছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বাইডেন প্রশাসনের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ বন্ধুপ্রতীম দুদেশের সম্পর্ককে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
শেখ হাসিনার অধীনে অর্থনৈতিক পরিবর্তন
শেখ হাসিনা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছেন। ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ গত এক দশকে বার্ষিক ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করেছে । এদেশের সামাজিক সূচকগুলোও বেশিরভাগ দক্ষিণ এশিয়ার দেশের তুলনায় ভাল।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশ গত ৫০ বছরে প্রচুর অগ্রগতি করেছে। জন্মের সময় বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি থেকে এটি এখন দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। ২০২২ সালে করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর খাদ্য, জ্বালানি সঙ্কটসহ নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে আইএমএফ থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে।
চীনের পদক্ষেপ
বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কের টানাপোড়েন শেখ হাসিনার সরকারকে চীনের বলয়ে যেতে সহায়তা করেছে। জুন মাসে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, তারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন। চীন আরও বলেছে, তারা স্বাধীন অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি সমুন্নত রাখতে এবং তার জাতীয় বাস্তবতার সাথে মানানসই একটি উন্নয়নের পথ অনুসরণ করতে বাংলাদেশকে সমর্থন করে।
বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি হচ্ছে প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব। এটি ১৯৮০ এর দশকে শুরু হয়েছিল এবং পরবর্তী বছরগুলোতে তা যথেষ্ট বেড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সরবরাহের ৭২ শতাংশই চীনের। পাকিস্তানের পর চীনের অস্ত্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য ঢাকা। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়ের জন্যই উদ্বেগের প্রধান কারণ।
বাংলাদেশে যুক্তেরাষ্ট্রের স্বার্থ
ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী। এশিয়া ইনস্টিটিউটের এক মুখপাত্র বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ঢাকার সাথে শক্তিশালী অংশীদারিত্বে আগ্রহী। তবে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তাগিদ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
শেখ হাসিনার সরকার যদি আসন্ন নির্বাচনে হেরে যায় তাহলে বাংলাদেশের কয়েক বছরের অর্জন ম্লান হয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছে ফ্রন্ট লােইন। এতে দেশটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে আবারও সন্ত্রাসী ও মৌলবাদী শক্তির উত্থান হতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিদায় শুধুমাত্র ভারতের জন্য নয় বরং সমগ্র অঞ্চলের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেও জানানো হয়েছে।
সিটি নিউজ ঢাকার ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন
জেকেএস/