• ঢাকা শুক্রবার
    ০৮ নভেম্বর, ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

আঁখির মৃত্যুতে স্বজনদের আহাজারি

প্রকাশিত: জুন ১৯, ২০২৩, ০২:০৩ এএম

আঁখির মৃত্যুতে স্বজনদের আহাজারি

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

রাজধানীর সেন্ট্রাল হসপিটালে ভুল চিকিৎসা এবং কর্তৃপক্ষের প্রতারণায় মাহবুবা রহমান আঁখি ও তার নবজাতকের মৃত্যুতে শোকে কাতর স্বজনরা। ল্যাবএইড হাসপাতাল থেকে আঁখির মরদেহ বের করে আনার সময় তার স্বজনদের আহাজারি করতে দেখা যায়। 

রোববার (১৮ জুন) বিকেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আঁখির মৃত্যুর ঘটনা বর্ণনা করেন তার বড় চাচা মো. শফিকুর রহমান মজুমদার।

তিনি বলেন, আমরা যখন সেন্ট্রাল হাসপাতালে গিয়েছি তখন কর্তৃপক্ষ জানায় যে, ডা. সংযুক্তা সাহা আছেন আপনারা চিন্তা করবেন না। আমাদের বলা হয় যে, ডাক্তার আঁখির চিকিৎসা করছেন। কিন্তু এটা ছিল ভুল তথ্য, ডাক্তার সেখানে ছিলেনই না। তারপর ওনারা আমাদের ভোর ৪টায় বলেন আপনাদের রোগী আইসিইউতে আছে। ওনারা দুপুর ১২টা পর্যন্ত আমাদেরকে আঁখির সঙ্গে কথা বলতে কোনো সুযোগই দেননি। তারা আঁখির ব্যাপারে কোনো ইনফরমেশন দেননি। 

তিনি আরও বলেন, আমরা অনেক কষ্টে প্রশাসনের মাধ্যমে জানতে পারলাম, আঁখির হার্টের সমস্যা রোগীকে স্থানান্তর করতে হবে। তারপর রোগীকে বের করে ল্যাবএইডে নিয়ে আসি। আমাদের রোগীকে ৪০ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে। ওইদিনই নবজাতক শিশুটা মারা গেছে। পরে তাদেরকে আমরা বলেছি, শিশুর মরদেহ হিমাগারে রাখতে। আমরা ডা. সংযুক্তা সাহার ফাঁসি চাই। সেইসঙ্গে সেন্ট্রাল হসপিটালের সব কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।

dhakapost

এসময় আঁখির চাচাতো বোন আহাজারি করছিলেন আর বলছিলেন, আমি আঁখিকে কখনো চাচাতো বোন হিসেবে দেখিনি, সবসময় নিজের বোনের মতো দেখতাম। তার কোনো ভাই-বোন নেই। কিছুদিন আগে আমার বাচ্চা হয়েছে, তখন আমার কাছে জানতে চেয়েছিল যে, আমি বাচ্চার জন্য কী কী ব্যবহার করছি... সেও তার বাচ্চার জন্য সেগুলো ব্যবহার করবে।

জানা গেছে, মাহাবুবা রহমান আঁখি গর্ভধারণের পর থেকেই ধানমন্ডি সেন্ট্রাল হসপিটালের অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার (গাইনি) কাছে নিয়মিত চিকিৎসা নিতেন। এ অবস্থায় গত ৯ জুন তার প্রসব বেদনা শুরু হয়। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে ডা. সংযুক্তা সাহার সহকারী মো. জমিরের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে জানতে চাওয়া হয় তিনি (সংযুক্তা সাহা) হসপিটালে আছেন কি না। জমির আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী সুমনকে জানান ডা. সংযুক্তা সাহা হসপিটালে আছেন এবং তাদের দ্রুত আসতে বলেন। পরে ইয়াকুব আলী তার স্ত্রীকে বাসা থেকে নিয়ে রাত সাড়ে ১২টার দিকে সেন্ট্রাল হসপিটালে ডা. সংযুক্তা সাহার চেম্বারের সামনে পৌঁছান।

সেসময় হসপিটালের চিকিৎসক ডা. মুনা সাহা ইয়াকুবকে জানান, ডা. সংযুক্তা সাহা লেবার ওয়ার্ডে আছেন। এই কথা বলে ডা. মুনা সাহা মাহাবুবা রহমানকে লেবার ওয়ার্ডে নিয়ে যান। সেসময় তাদের পেছনে পেছনে বাদীও লেবার ওয়ার্ডের সামনে যান। এর কিছুক্ষণ পর একজন নার্স লেবার ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে ইয়াকুব আলীকে জানান, তার স্ত্রীকে হসপিটালে ভর্তি করাতে হবে। নার্সের এমন কথা শুনে, ইয়াকুব আলী ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে ভর্তি বাবদ ক্যাশ কাউন্টারে ১০ হাজার টাকা জমা দিয়ে মানি রিসিট লেবার ওয়ার্ডের নার্সের কাছে জমা দেন।

তিনি বলেন, এর কিছুক্ষণ পর ডা. শাহজাদী গাহিনী ওয়ার্ডে এলে তার কাছে ইয়াকুব আলী নিজের স্ত্রীর শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চান। কিন্তু ইয়াকুবের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে তাকে গেটের বাইরে অপেক্ষা করতে বলেন ডা. শাহজাদী।

এরপর রাত ১টা ২০ মিনিট পর্যন্ত ইয়াকুবের স্ত্রীর শারীরিক অবস্থার কোনো খবর না পেয়ে একপর্যায়ে জোরপূর্বক লেবার ওয়ার্ডে প্রবেশ করেন। তিনি ভেতরে প্রবেশ করে দেখেন কয়েকজন নার্স মিলে তার স্ত্রীকে দ্রুত গতিতে হাঁটাচলা করাচ্ছেন। এসময় ইয়াকুব নার্সদের জিজ্ঞেস করেন ডা. সংযুক্তা সাহা কোথায়। কিন্তু নার্সরা ইয়াকুবের কথার উত্তর না দিয়ে তাকে লেবার ওয়ার্ডের বাইরে অপেক্ষা করতে বলেন।

এরপর রাত ২টা ৩০ মিনিটের দিকে ডা. শাহজাদী আঁখিকে লেবার ওয়ার্ড থেকে বের করে অপারেশন থিয়েটারে (ওটিতে) নিয়ে যান। এসময় ডা. এহসান নামে আরও একজন চিকিৎসক ওটিতে প্রবেশ করেন। ওটিতে সিজারিয়ান অপারেশন শেষে ডা. শাহজাদী ইয়াকুব ও আঁখি দম্পতির নবজাতক শিশুকে (ছেলে) জীবিত অবস্থায় এনআইসিইউ নিয়ে যান। পরে রাত সাড়ে ৪টার দিকে একজন নার্স ওটি থেকে বের হয়ে ইয়াকুব আলীকে জানান, তার স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক তাই কিছু কাগজে তাকে সই দিতে হবে। কাগজে কেন সই দিতে হবে জানতে চাইলে নার্স ইয়াকুব আলীকে জানান, তার স্ত্রীকে বাঁচাতে হলে এই কাগজে সই করতে হবে। অন্যথায় ইয়াকুবের স্ত্রী আঁখি ও তার নবজাতকের চিকিৎসা তারা করবেন না। এই কথা শুনে নিরুপায় হয়ে স্ত্রী ও সন্তানের জীবন বাঁচাতে সেই কাগজে সই করেন ইয়াকুব আলী।

অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার অনুপস্থিতিতে ওই রাতে আঁখির সিজারিয়ান অপারেশন কোন চিকিৎসক করেছেন তা ইয়াকুব আলীকে জানানো হয়নি। এর মধ্যে ভোর ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে আঁখির শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। এ ঘটনায় ইয়াকুব আলী বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে সেন্ট্রাল হসপিটালের ডেপুটি ডিরেক্টর মাসুদ পারভেজকে মৌখিকভাবে জানান। 

এরপর ইয়াকুব তার স্ত্রী ও নবজাতকের শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চাইলে এ বিষয়ে সেন্ট্রাল হসপিটাল কর্তৃপক্ষ তাকে কোনো তথ্য না দিয়ে আঁখিকে অন্য হসপিটালে চিকিৎসা করানোর জন্য বলে। ইয়াকুব সেন্ট্রাল হসপিটালের কোনো সহযোগিতা না পেয়ে পরে তার স্ত্রীকে ল্যাবএইড হসপিটালে ভর্তি করান। পরদিন অর্থাৎ ১০ জুন সেন্ট্রাল হসপিটালের কর্তৃপক্ষ ইয়াকুবকে জানায়, তার সন্তান বিকেল ৪টার দিকে এনআইসিইউতে মারা গেছে।

এ ঘটনায় বুধবার ধানমন্ডি থানায় ‘অবহেলাজনিত মৃত্যু’র একটি মামলা দায়ের করেন ইয়াকুব আলী। মামলায় ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা, ডা. মুনা সাহা, ডা. মিলি, সহকারী জমির, এহসান ও হাসপাতালের ম্যানেজার পারভেজকে আসামি করা হয়। এছাড়াও অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকেও আসামি করা হয়েছে। মামলা দায়েরের পর ১৫ জুন রাতে ডা. শাহজাদী ও ডা. মুনা সাহাকে হাসপাতাল থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এদিকে আজ (রোববার) দুপুর ১টা ৪৩ মিনিটে ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আঁখির মৃত্যু হয়। 

 

বিএস/

আর্কাইভ