• ঢাকা রবিবার
    ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১১ ফাল্গুন ১৪৩১

জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বিশ্বে ‘মডেল’ বাংলাদেশ

প্রকাশিত: জুলাই ২, ২০২১, ০১:১৬ এএম

জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বিশ্বে ‘মডেল’ বাংলাদেশ

ফারাজী আজমল হোসেন

একটি রাষ্ট্রের জন্য জঙ্গিবাদ বিষয়টা কতটা ক্ষতিকর তার প্রমাণ আমাদের সামনে অনবরত রেখে যাচ্ছে পাকিস্তান। জঙ্গিবাদের লালন-পালন, অর্থায়ন, অস্ত্র সরবরাহ সব দিকেই পাকিস্তান বর্তমানে বিশ্বে শীর্ষে। আর মূলত এই কারণেই দেশটিতে বিনিয়োগ করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অধিকাংশ দেশ। 

পাকিস্তানের দেখানো সেই পথেই এক সময় হেঁটেছে বাংলাদেশ। ২০০৩-০৪ বর্ষে বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের কাছে জঙ্গিবাদের তকমাও পেয়েছে। এ সময় বাংলাদেশ থেকে তালেবান ও আল-কায়েদায় যোগ দিতে যুবকদের প্রেরণের কথা কারও অজানা নয়। কিন্তু সে সবই আজ অতীত।জঙ্গিবাদের সেই রাস্তা ছেড়ে আজ উন্নয়নের রাস্তায় বাংলাদেশ। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নয়, একটি রাষ্ট্র যে শুধু উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্বে নিজেদের অবস্থান নতুন করে তৈরি করতে পারে তার প্রমাণ আজ বাংলাদেশ।

১৯৮৬ সালে ‘মুসলিম মিল্লাত বাহিনী’-এর মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম জঙ্গিবাদের সূচনা ঘটে। প্রায় ৫০০ জনের বেশি পুলিশ সদস্য দুইদিনব্যাপী সংঘর্ষের মাধ্যমে এই জঙ্গি সংগঠনকে দমন করে। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে এর প্রধান মেজর (অব.) মতিউর রহমান গ্রেফতারের পরও মুক্তি পেয়ে যান। তার থেকে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সূত্র যার হাত ধরে তার বিষয়ে কোনো তথ্য জানে না বাংলাদেশের কোনো গোয়েন্দা সংস্থা!

১৯৯২ সাল থেকে অবশ্য নতুন উদ্যমে বাংলাদেশে শুরু হয় জঙ্গিবাদ। যার পূর্ণ বিকাশ ঘটে চারদলীয় জোট যখন ক্ষমতায় যায়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জে সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াকে হত্যা করা পর্যন্ত হুজি-বি ৬ বছরে দেশে ১৩টি বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে মোট ১০৯ জন নিহত হন। আহত হয় ৭০০ জনের বেশি মানুষ। অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান।

এর মধ্যে হুজি-বি’র জঙ্গিরা সবচেয়ে বড় ও ভয়াবহ হামলা চালায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, ঢাকায় তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার জনসভায়। ওই গ্রেনেড হামলায় ২২ জন নিহত হন। আহত হন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কয়েক’শ নেতা-কর্মী। এ ঘটনার পর আর্জেস গ্রেনেড আলোচনায় আসে। একই ধরনের গ্রেনেড ব্যবহার করে ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটে হজরত শাহজালালের (রহ.) মাজারে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে যে এসব গ্রেনেডের চালান এসেছিল পাকিস্তান থেকে।

মজাদার বিষয় হলো বাংলাদেশে হওয়া সব জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে একাধিক দেশের নাম আসলেও সব
ক্ষেত্রে একটি দেশের নাম ছিল স্থায়ী। আর তা হলো পাকিস্তান। হুজি, জেএমবি, নব্য জেএমবি, আনসারুল্লাহ ইসলাম বাংলাদেশ থেকে শুরু করে সব জঙ্গি সংগঠনের অর্থ, অস্ত্র বা প্রশিক্ষণ সহায়তা এসেছে পাকিস্তানের কাছ থেকে। এমনকি শায়েখ আব্দুর রহমানকে পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে বারবার আসে পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর নাম।

কিন্তু যেই রাষ্ট্রের জন্ম ধর্ম নিরপেক্ষতা থেকে, সেই রাষ্ট্র কীভাবে জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে? আর সে কারণেই চারদলীয় জোটের জঙ্গি কার্যক্রমে অতিষ্ঠ হয়ে এ দেশের মানুষ রেকর্ড সংখ্যক ভোটে বিজয়ী করে ক্ষমতায় নিয়ে আসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে। কেন না বঙ্গবন্ধুর মতোই শেখ হাসিনাও জীবনের পরোয়া না করে দেশের কল্যাণে এগিয়ে এসেছেন সর্বদা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন দেশের খেটে খাওয়া মানুষের জন্য বৈষম্যমুক্ত এক সমাজ ব্যবস্থা। কিন্তু পাকিস্তানি মৌলবাদী সর্বগ্রাসী চেতনা এবং দেশের কতিপয় মীরজাফরের চক্রান্তে সপরিবারে নিহত হন বাঙালি জাতির এই মহানায়ক। মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক সদ্য স্বাধীন পাওয়া দেশে বপন করা হয় ধর্মীও উগ্রতাবাদ, মৌলবাদ ও সন্ত্রাসের বীজ। 

বাংলাদেশে বর্তমানে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াত ইসলামকে রাজনীতির সুযোগ করে দেয়ার মাধ্যমে নিজ হাতে সেই বীজকে চারা গাছে পরিণত করতে সরাসরি সহায়তা করেছেন জিয়াউর রহমান। আর সেই জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের বীজ মহীরুহতে পরিণত হয় যখন জিয়ার ছেলে তারেক রহমানের নিয়ন্ত্রণে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। 

এ সময় বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে পাকিস্তানের মতো জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয় বিএনপি-জামায়াত। আর জঙ্গিবাদের সেই মহীরুহের পতন ঘটে শেখ হাসিনার হাতে। বঙ্গবন্ধুর বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয়কে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনার দৃঢ় ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কল্যাণে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বীজ বপন করা জামায়াত ইসলাম আজ নিষিদ্ধ সংগঠন। খুব সম্ভবত এ কারণেই বঙ্গবন্ধু পরিবারকে নিয়ে এত ভয় ছিল পাকিস্তান ও তার সঙ্গী জামায়াত ইসলামের। শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টাও করেছেন তারা। কিন্তু তাতে দমে যাননি বঙ্গবন্ধু কন্যা। তিনি বলেন, ‘আমার আর হারানোর কিছু নেই।’

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শেখ হাসিনা যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করেন ১৯৮১ সালে, তখন এই দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যুদ্ধাপরাধীরা। তাদের গাড়িতে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। কিন্তু শৈশব থেকেই রাষ্ট্রীয় চোখ রাঙ্গানোতে পিতার আন্দোলন সংগ্রাম দেখে এসেছেন শেখ হাসিনা। সুতরাং এত সহজে দমানো তাকে সম্ভব নয়। এ জন্যই তাকে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে ১৯ বারেরও বেশি। তারপরও লড়াই চালিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে নতুন করে পরিচিত করতে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। 

২০০১-০৬ সালে বিএনপি জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালে যেই বাংলা ভাই, শায়েখ আবদুর রহমানের হাত ধরে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে দেশে, তা দমনে দেশে শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলার ঘোষণা দেন তিনি। আর ২০১৩ সালে বাংলাদেশে গড়ে ওঠে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। এ সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা জামায়াত ইসলামের জঙ্গি নেটওয়ার্ককে খুঁজে বের করতে সমর্থ হয় পুলিশ। আর বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র ও সংগঠনের চোখ রাঙ্গানোকে উপেক্ষা করে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাংলাদেশ।

কিন্তু তারপরও পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ধর্মীও প্রচারের নামে দেশে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করতে থাকে জঙ্গিবাদের মন্ত্র। এর ফল ছিল ২০১৬ সালের হলি আর্টিজেনে হামলা। এক দল তরুণের মাথায় জঙ্গিবাদের বীজ ঢুকিয়ে হাতে তুলে দেয়া হয় অস্ত্র। তাদের রাতভর হামলায় নিহত হন ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জন।

অনেক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত সময়কালকে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ‘ইনকিউবেশান পিরিয়ড’ বলে মনে করেন। রহমান এবং কাসেম তাদের সেই গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন যে, ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশীয় জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান এবং দেশে-বিদেশে তাদের নেটওয়ার্কের ব্যাপক প্রসার ঘটে, ২০০১ সাল থেকে ২০০৭ সালের শেষ পর্যন্ত জঙ্গিবাদের ভয়াবহ রূপ বাংলাদেশ দেখেছে। বেড়ে গিয়েছিল যত্রতত্র বোমা হামলার ঘটনা। এসব বোমা হামলায় মারা গেছে অসংখ্য মানুষ। মূলত, মূলধারার রাজনীতি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে ।

২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত যেসব জঙ্গি সংগঠন অবাধে তাদের কার্যকলাপ পরিচালনা করেছিল, তাদের মধ্যে চারটি জঙ্গি গোষ্ঠী জনবল, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, সক্ষমতা ও দক্ষতার জন্য বেশি আলোচিত ছিল। সেগুলো হলো, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদুল ইসলামী ও হিজবুত তওহিদ। বাংলাদেশে জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম, গবেষক ও পশ্চিমা দুনিয়ার আগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারা খুঁজতে থাকে বাংলাদেশ জঙ্গি গোষ্ঠীর নতুন আশ্রয়স্থল হওয়ার পিছনের কারণ এবং জঙ্গি গোষ্ঠীর কার্যক্রমের পরিধির বিষয়ে।

সাউথ এশিয়া স্টাডিজের তথ্যানুসারে, বিশ্বব্যাপী এই জঙ্গিবাদের উত্থানের জন্য তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারে জঙ্গিবান্ধব মনোভাব এবং অনেকে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সহায়তাকেই দায়ী করা হয়।

জঙ্গিদের আইনের আওতায় আনার জন্য বিভিন্ন পর্যায় থেকে চাপ থাকায় বিএনপি-জামাত জোট সরকার ২০০৫ সালের শেষের দিক দিয়ে কিছু ব্যবস্থা নেয়, কিছু জঙ্গি নেতার ফাঁসি হয়েছিল তখন। ২০০৭ সালে দত্ত এক লেখায় বিষয়টি উল্লেখ করেন।

২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে কানাডিয়ান ইন্টেলিজেন্স সিকিউরিটি সার্ভিসেস এক রিপোর্টে উল্লেখ করে, দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামি সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না বাংলাদেশ সরকার, যার কারণে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পৃক্ত জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান হচ্ছে।

২০০১ সালের ১৪ এপ্রিলে রমনা পার্কের বটমূলে বাংলা নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় ১০ নিহত ও একশরও বেশি আহত হয়েছে। একই বছর ২৪ ও ২৫ সেপ্টেম্বরে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী সভায় জঙ্গিদের বোমা হামলায় ৮ এবং ৪ জন যথাক্রমে মারা যান। আহতের সংখ্যা শতাধিক।

২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরাতে শক্তিশালী দুটি বোমা হামলায় মারা যায় ৩ জন, আহতের সংখ্যা ছিল ১২৫ এরও বেশি। এই বছর ৭ ডিসেম্বর সিরিয়াল বোমা হামলা চালানো হয় ময়মনসিংহের সিনেমা হলগুলোতে। মারা যায় ১৮ জন, আহত হয়েছিলেন ৩০০ জন। ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জ শহরে দানিয়ার এক মেলাতে বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় ৮ জনকে। আহত হন অনেকে।

২০০৪ সালের ১২ জানুয়ারি সিলেটের হযরত শাহ জালাল দরগার শরীফে এক বোমা হামলায় ১০ জন মারা যায় এবং আহত হয় ১৩৮ জন। এই বছর ২১ মে সিলেটে তখনকার ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে লক্ষ্য করে চালানো বোমা হামলায় হাইকমিশনার বেঁচে গেলেও মারা যায় অন্য দু’জন, আহত হয় ২০ জন। একই বছরের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক সিরিয়াল গ্রেনেড হামলার ঘটনাটি ঘটে। এতে নিহত হয় ২৩ জন, আহত হয় পাঁচ শতাধিক। এ হামলায় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের একটি বৃহৎ অংশ, বিশেষ করে বিএনপির শক্তিশালী তরুণ নেতৃত্ব ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০০৫ সালে ১ জানুয়ারি বগুড়া ও নাটোরে বোমা হামলায় মারা যায় ৩ জন, আহতের সংখ্যা সত্তরের অধিক। একই মাসে হবিগঞ্জের বৈধর বাজারে আওয়ামী লীগের সমাবেশে বোমা হামলায় মারা যান সাবেক অর্থমন্ত্রী গোলাম কিবরিয়াসহ পাঁচ জন। আহত হয় ১৫০ জন। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে একযোগে প্রতিটি জেলায় বোমা হামলা করা হয়। জঙ্গিরা তাদের অপারেশনাল সক্ষমতা কেমন তা দেশবাসীকে জানান দেয় এভাবেই। নভেম্বরের ১৪ তারিখে ঝালকাঠিতে দু’জন সহকারী জেলা জজকে বোমা মেরে হত্যা করা হয়। ২৯ নভেম্বরে চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও টাঙ্গাইলে একসঙ্গে বোমা হামলা করা হয়। এ হামলায় নিহতের সংখ্যা ৯, আহতের সংখ্যা ৭৮।

২০০৬ সালের ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনায় উদীচী কার্যালয়ের সামনে এক বোমা হামলায় নিহত হয় ৮ জন, আহত ৪৮ জন। গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৩ সালে জেএমবি, হিজবুত তাহিরির, হরকাতুল-জিহাদ-উল-ইসলাম (হুজি) ও ইসলামিক বিপ্লবী পরিষদকে (আইডিপি) নিষিদ্ধ করার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু সরকারের ভিতরের জঙ্গিবাদের সমর্থক অংশের বাধার কারণে সরকার তা করতে ব্যর্থ হয়, বরং জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সহায়তা দিয়ে যাওয়া হয়েছে।

বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের অনেক নেতাই জঙ্গি গোষ্ঠীর ‘গডফাদার’হিসেবে কাজ করেছিলেন। জঙ্গি সংগঠন জেএমজেবির নেতা মওলানা শায়খ রহমান ও বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে বিএনপির একাংশের এবং জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্কটি ছিল দিনের আলোর মতই পরিষ্কার। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল ইসলাম (জঙ্গি কর্মকাণ্ডের উপদেষ্টা), ভূমি উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস দুলু (২০০৪ সালে এপ্রিল মাসে দুলুর বাসায় শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাই দলবল নিয়ে মিটিং করেন), গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির (যিনি মোবাইলে শায়খ রহমান ও বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতেন এবং ওদের বাসায় দাওয়াত দিয়েছিলেন), তৎকালীন মেয়র মিজানুর রহমান মিনু (মাহাবুব নামের এক জঙ্গির কাছে বাংলা ভাইয়ের জন্য ৫০ হাজার টাকার ব্যাংক চেক দিয়েছিলেন), সাবেক সংসদ সদস্য নাদিম মোস্তফা (যিনি পুঠিয়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিনুল ইসলামের মাধ্যমে ৩০ হাজার টাকা বাংলা ভাইয়ের হাতে তুলে দেন) ও সংসদ সদস্য আবু হেনার (যিনি আপন ভাতিজার মাধ্যমে বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন) নিবিড় সম্পর্ক ছিল জেএমজেবির সঙ্গে।

তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াতের এই জঙ্গি কার্যক্রম বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভারতে পৌঁছায়। সেখানের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের কাছে অস্ত্র পৌঁছে দিতে ১০ ট্রাক অস্ত্র খালাস করা হয় চট্টগ্রাম বন্দরে যা ঘটনাক্রমে জনসম্মুখে চলে আসে। তারেক রহমানের কল্যাণে এবং জামায়াত ইসলামের সহায়তায় বাংলাদেশে গড়ে ওঠা জঙ্গি নেটওয়ার্ক দমনে ২০১১-১৩ সালে বেশ হিমশিম খেতে হয়।

শুধুমাত্র শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বের কারণে এই সময় হাল ছাড়েনি বাংলাদেশ। দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে গড়ে ওঠা জঙ্গি নেটওয়ার্ক ও তাদের অর্থের উৎস খুঁজে বের করে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন করেছেন শেখ হাসিনা। এখন আর পার্বত্য চট্টগ্রামে জঙ্গি ট্রেনিং হয় না। উত্তর বঙ্গে বাংলা ভাইদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায় না। যেকোনো মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে কঠোরভাবে দমন করছে বাংলাদেশ। আর এ সবকিছু সম্ভব হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কারণে। তার হাত ধরেই আজ জঙ্গি রাষ্ট্রের বদলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিশ্বের বুকে পরিচিতি পাচ্ছে বাংলাদেশ।

জাতিসংঘে আজ বাংলাদেশের প্রশংসা করা হচ্ছে জঙ্গি মোকাবিলার জন্য। জঙ্গিবাদের উত্থান রুখে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া এক দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে রোল মডেল আজ বাংলাদেশ। এ দেশের সাধারণ মানুষ মৌলবাদী নয়, এদেশের মানুষ এখনও বুকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা। আর সে কারণেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জঙ্গিবাদ দমনে এমন নিদর্শন স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

জাতীয় সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ