• ঢাকা বৃহস্পতিবার
    ০৭ নভেম্বর, ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

রাজনীতির মাঠে সংলাপের আলাপ

প্রকাশিত: জুন ৯, ২০২৩, ০২:৪২ এএম

রাজনীতির মাঠে সংলাপের আলাপ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

রাজনীতির মাঠে চলছে সংলাপের আলাপ। মঙ্গলবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের সমাবেশে প্রথম এনিয়ে কথা বলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু।

মঙ্গলবার (৬ জুন) রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ১৪ দল আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় আমু বলেন, আলোচনা বাদে অন্যকোনো পন্থায় সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। আর অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় আসার পাঁয়তারা করলে প্রতিরোধ করবে জনগণ।

তিনি বলেন, প্রয়োজনে জাতিসংঘের প্রতিনিধির সামনে বিএনপির সঙ্গে মুখোমুখি বসে রাজনৈতিক সংকট ও আগামী নির্বাচনের একটা সুরাহা করতে চায় আওয়ামী লীগ।

পরদিন বুধবার (৭ জুন) একই ইস্যুতে গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে অবস্থান পরিষ্কার করেন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা।

দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপির সঙ্গে আলোচনার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তাছাড়া বিদেশিরা নয়, নিজেরাই নিজেদের সমস্যা সমাধান করবেন বলে জানান তিনি।

ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের কাদের আরও বলেন, সংকটের একমাত্র সমাধান সংবিধান। দেশে এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যে, বিদেশিদের মধ্যস্থতা করতে হবে।

আমুর বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি আওয়ামী লীগের বক্তব্য নয়, আওয়ামী লীগ এখনও বিএনপির সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত নেয়নি।

এ প্রসঙ্গে বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘আমাদের এক নেতা বিএনপির সঙ্গে সংলাপের কথা বলেছেন। অবশ্যই সংলাপ ও আলোচনার বিকল্প কিছু নেই। আওয়ামী লীগ বরাবরই সংলাপে বিশ্বাসী।’

এদিকে একই দিন সংলাপ নিয়ে আমুর দেয়া বক্তব্য প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হতে পারে’ ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর এ বক্তব্য তার নিজস্ব। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি।

হাছান মাহমুদ বলেন, বিএনপি হচ্ছে একটি সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দল। কানাডার আদালতের রায় অনুযায়ী, সিলমারা সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দল বিএনপি। যারা অগ্নিসন্ত্রাস চালায়, মানুষের ওপর হামলা চালায়, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে কী হবে, সেটি হচ্ছে বড় বিষয়।


অতীত অভিজ্ঞতায় যারা নির্বাচন ঠেকাতে চায়, সেই সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় কোনো ফল আসবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

একদিন পরই নিজের দেয়া আগের বক্তব্য থেকে কিছুটা সরে আসেন আমির হোসেন আমু। বুধবার ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবসে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি বলেন, কাউকে দাওয়াত দিয়ে সংলাপে ডাকা হবে না।

আমু বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো সংলাপও আহ্বান করা হয়নি। সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। সব দলকে তা মেনেই নির্বাচনে আসতে হবে।
 
তিনি বলেন, জনগণ ভোটের মাধ্যমে কারা সরকারে থাকবে, সেই সিদ্ধান্ত নেবে। এর ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নেই। দেশে আর কখনোই সাংবিধানিক সংকট তৈরি হতে দেবে না আওয়ামী লীগ।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর টালমাটাল রাজনীতির পরিবেশ। নানা পট পরিবর্তনের পর ক্ষমতার মসনদে জিয়াউর রহমান। জিয়ার বিশেষ সহকারী হিসেবে ১৯৭৬ সালের ২২ জানুয়ারি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

১৯৮৪ সালের ৯ এপ্রিল বঙ্গভবনে সাত দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সাত দলের পক্ষ থেকে ৩০ দফা দাবি উত্থাপন করা হয় এরশাদের কাছে। এরশাদ দাবি না মানলে সাত দলের নেতা সংলাপ কক্ষ ছেড়ে বের হয়ে আসেন।

১৯৮৪ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গভবনে জামায়াতের সঙ্গে সংলাপ করেন এরশাদ। ১১ এপ্রিল এরশাদ সংলাপ করেন ১৫ দলের নেতাদের সঙ্গে। ১২ এপ্রিল এরশাদ বঙ্গভবনে বসে বৈঠক করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে। ১৪ই এপ্রিল দ্বিতীয় দফা বৈঠক করেন ১৫ দলের নেতাদের সঙ্গে।  ২৮ এপ্রিল আবারও বঙ্গভবনে এরশাদের সঙ্গে সংলাপ হয় ১০ দলের। কিন্তু কোনো সংলাপ ফলপ্রসু হয়েছে বলে জানা যায়নি।

১৯৮৭ সালে সব বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির অব্যাহত আন্দোলনে কোনঠাসা এরশাদ সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিলেন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি। রাজনৈতিক নেতারা প্রত্যাখ্যান করে সে আহ্বান। ওই বছরের ২৮ অক্টোবর এরশাদবিরোধী আন্দোলনের দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে একটি বৈঠক হয়েছিলো। একই বছরের ২৮ নভেম্বর স্বৈরশাসক এরশাদ আবারও সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিলেন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি। কিন্তু কোনো দলের কাছ থেকেই তেমন সাড়া মেলেনি। পরে প্রবল আন্দোলনের মুখে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে পদত্যাগে বাধ্য হন এরশাদ।

নব্বই পরবর্তী রাজনৈতিক ইতিহাসে চোখ রাখলে দেখা যায়, নির্বাচন এগিয়ে এলেই সামনে আসে সংলাপ প্রসঙ্গ। এসব সংলাপ কখনও হয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, কখনও নেতাদের মধ্যে। কখনো আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদেরও দেখা গেছে সংলাপের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে।

১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। তাদের ক্ষমতার শেষদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নামে প্রায় সব বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি। ১৯৯৪ সালের ৩১ আগস্ট সরকারি ও বিরোধী দলের দুই উপনেতার বৈঠক হয়। একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর সে সময়ের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয় বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের।

উদ্যোগ নেয়া হয় দুই প্রধান নেত্রীর বৈঠকের। কমনওয়েলথ মহাসচিব এনিয়াওকুর এমেকা ওই বছরের ১৩ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় এসে দেখা করেন দুই নেত্রীর সঙ্গে। এমেকা পরে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠান স্যার স্টিফেন নিনিয়ানকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক সংলাপ তত্ত্বাবধানে তার বিশেষত্ব ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে তিনি সফল হননি।

১৯৯৫ সালে আবার সংলাপের প্রস্তাব আসে সে সময়ের বিরোধীদল আওয়ামী লীগের কাছ থেকে। কিন্তু সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তখনকার সংসদ উপনেতা অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী।

তবে সংলাপ ব্যর্থ হলেও ১৯৯৬ সালে একতরফা নির্বাচন করেও টিকতে পারেনি বিএনপি। আওয়ামী লীগসহ অন্য বিরোধীদলগুলোর আন্দোলনের মুথে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় বিএনপি।

২০০১ সালেও নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালিন সরকার নিয়ে দ্বন্দ্ব হয় আওয়ামী লীগ বিএনপির মধ্যে। সে সময় মধ্যস্থতার জন্য এসেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। তিনিও সংলাপ করেছিলেন দুই পক্ষের সঙ্গে। তার সে প্রচেষ্টাও ফলপ্রসূ হয়নি।

২০০৬ সালের অক্টোবরে সে সময়ের সরকারি দলের মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া এবং বিরোধীদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল দফায় দফায় বৈঠক করেন। তিন সপ্তাহ ধরে ধারাবাহিক সংলাপে বিএনপি মহাসচিবের কাছে ২৯ দফা প্রস্তাব দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। ছয় দফা বৈঠক করেও তারা কোনো সমাধানে আসতে পারেননি।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২০১৩ সালের শেষ দিকে ঢাকায় আসেন জাতিসংঘ মহাসচিরের বিশেষদূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। ছয়দিন ঢাকায় অবস্থান করে ১০ ও ১১ ডিসেম্বর বৈঠক করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। তৃতীয় বৈঠক হয় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি নিল ওয়াকারের উপস্থিতিতে। কোনো বৈঠকই সফল হয়নি।

এর আগে ওই বছরের ২৬ অক্টোবর টানটান রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণবভবনে সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়ে ফোন করেন সে সময়ের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে।

এছাড়া ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও আনুষ্ঠানিক সংলাপ হয় দুই রাজনৈতিক জোটের মধ্যে। ২০১৮ সালের পয়লা নভেম্বর গণভবনে অনুষ্ঠিত সে সংলাপে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফন্ট্রের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বেশ কয়েকজন নেতা। আর আওয়ামী জোটের নেতৃত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৪ দলের নেতারা।

নির্বাচনের আগে ছোট পরিসরে আরও একটি সংলাপ হয় দুই জোটের মধ্যে। এবার দ্বাদশ জাতীয সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আনুষ্ঠানিক সংলাপের কথা এখনও সামনে আসেনি। তবে ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত গেল কয়েকদিনে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছেন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে। কখনও দুইদলের নেতারা একত্রে বসেছেন তার সঙ্গে। কখনও আবার আলাদা।


এডিএস/

আর্কাইভ