প্রকাশিত: মে ১৮, ২০২৩, ০৩:১৪ এএম
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ও স্মরণীয় দিন ১৭ মে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘ নির্বাসন শেষে ১৯৮১ সালের এই দিনেই বাংলার মাটিতে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এখন থেকে ৪৩ বছর আগে বাংলাদেশ যখন প্রকৃত নেতৃত্বের সংকটে নিমজ্জিত, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার যখন ভূলুণ্ঠিত; ঠিক তখন বাংলার জনগণ এক অকুতোভয় নারীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন প্রত্যক্ষ করে, যার ওপর তারা নির্ভর করতে পারে।
দীর্ঘদিনের পরবাস থেকে তার এই নিজভূমে প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশ ও এর কয়েক কোটি জনগণের জন্য এক নতুন যুগের সূচনা করে। একটি সমৃদ্ধ, উন্নত ও সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে মানুষ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অনেক ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই দেশ তার পথ হারায়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যের সঙ্গে ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এ সময় বিদেশে থাকায় ঘাতকের হাত থেকে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে বাঙালি জাতির অস্তিত্বকে বিপন্ন করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু করে ঘাতকগোষ্ঠী।
বঙ্গবন্ধুর আকস্মিক হত্যাকাণ্ড পুরো জাতিকে বাকরুদ্ধ করে দেয়। বাঙালি জাতির জীবনে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে ঘোর অমানিশার অন্ধকার। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দেশের শাসন ক্ষমতায় আসা সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার অধিকারসহ জনগণের সব ধরনের অধিকার কেড়ে নেয়।
এমন একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার পবিত্র দায়িত্ব অর্পণ করা হয় জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ কন্যার হাতে।
বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বকে ভয় পায় ঘাতকগোষ্ঠী। খুনি সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে না দেয়ার জন্য সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কিন্তু সব বাধা ডিঙিয়ে ও জীবনের মায়া তুচ্ছ করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশ ও দেশের মানুষের কাছে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা।
দীর্ঘ ছয় বছরের নির্বাসন শেষে তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন তৎকালীন সামরিক শাসকের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। তবে তার এই প্রত্যাবর্তনে দেশের সাধারণ মানুষ যেন নতুন করে জীবন ও প্রাণশক্তি ফিরে পায়।
আজীবন রাজনীতিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনার রক্তের মধ্যেই ছিল রাজনীতি। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি। উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র সংসদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ শাখার সদস্য ও রোকেয়া হল শাখার সেক্রেটারি ছিলেন তিনি।
এভাবে ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন সময়ে দেশের সব কটি গণ-আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা হয় শেখ হাসিনার। এসব অভিজ্ঞতা পুঁজি করে এবং সর্বোপরি বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে রাজনীতিতে নতুন যাত্রা শুরু করেন তিনি।
১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশে ফিরেছিলেন সম্পূর্ণ একা। কিন্তু নিজের সেই নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে উঠতে তার খুব বেশি সময় লাগেনি। কারণ, সেদিন তাকে অভ্যর্থনা জানাতে ঢাকা বিমানবন্দর রোড ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল।
রাজধানী ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ঢাকা শহর মিছিল আর স্লোগানে প্রকম্পিত হয়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া আর প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টিও সেদিন লাখো মানুষের মিছিলকে গতিরোধ করতে পারেনি। এটাই প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের মানুষ তার প্রত্যাবর্তনের জন্য অধীর অপেক্ষায় ছিল। কারণ তারা জানত, শুধু তিনিই সামরিক শাসনের নিগড় থেকে মানুষকে মুক্ত করতে পারবেন।
দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার, বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, স্বৈরতন্ত্রের চির-অবসান ঘটিয়ে জনগণের হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সার্বভৌম সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ও সরকার প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা।
ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নিরবচ্ছিন্ন দীর্ঘ সংগ্রাম শুরু হয়। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে সামরিক জান্তা ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে চলে তার অকুতোভয় সংগ্রাম।
কিন্তু সামরিক শাসনের অধীন মানুষের অধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে লড়াই ও সংগ্রাম কখনোই সহজ ছিল না। এক ছোট্ট পরিসংখ্যান দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে, সেই দিনগুলোতে শেখ হাসিনার পক্ষে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে নেয়া কতটা বিপজ্জনক ও কঠিন ছিল। পরবর্তী বছরগুলোতে তাকে হত্যা করতে অন্তত ১৯ বার হামলা চালানো হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন তিনি।
এ ছাড়া ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও হয়রানি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত অন্তত ছয়বার শেখ হাসিনাকে গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সামরিক সরকার তাকে ১৫ দিনের জন্য গৃহবন্দি করে রাখে। পরের বছর (১৯৮৪) একই সময়ে তাকে আবারও গৃহবন্দি করা হয়।
এরপর ১৯৮৫ সালের ২ মার্চ তাকে আবারও গ্রেফতার করা হয়। এবার তাকে গৃহবন্দি রাখা হয় প্রায় তিন মাস। ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে তাকে আরও ১৫ দিনের গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে তাকে গৃহবন্দি করা হয় এক মাসের জন্য। ১৯৮৯ সালে তাকে ফের গৃহবন্দি করা হয়। এরপর ১৯৯০ সালের নভেম্বরে আরও একবার গৃহবন্দি হন তিনি।
কিন্তু একের পর এক হত্যাচেষ্টা, গ্রেফতার ও জীবননাশের ভয়ভীতি তাকে কখনো তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। জেল-জুলুম-অত্যাচার কোনো কিছুই তাকে তার পথ থেকে টলাতে পারেনি। শত প্রতিকূলতায়ও হতোদ্যম হননি কখনো। বাংলার মানুষের হারিয়ে যাওয়া অধিকার পুনরুদ্ধার করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি বারবার স্বৈরাচারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেছেন, আবির্ভূত হয়েছেন গণতন্ত্রের মানসকন্যারূপে।
বঙ্গবন্ধুর খুনি ও একাত্তরের নরঘাতক মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্ন এবং রায় কার্যকর করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্ব, যোগ্যতা, নিষ্ঠা, মেধা-মনন, দক্ষতা, সৃজনশীলতা, উদার গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দূরদর্শী নেতৃত্বে একসময় দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষে জর্জরিত যে বাংলাদেশ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করত, সেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বজয়ের নবতর অভিযাত্রায় এগিয়ে চলছে।
বিশ্বসভায় আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ ঘুচিয়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সততা, মেধা, দক্ষতা ও গুণাবলিতে সমসাময়িক বিশ্বের অন্যতম সেরা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
জেকেএস/