প্রকাশিত: মে ২, ২০২৩, ০৬:৪৩ এএম
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছেন। জাপান সফর শেষে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছেন। সেখানে সরকারী বিভিন্ন কর্মসূচী পালনের পাশাপাশি ভয়েস অব আমেরিকার সঙ্গে কথা বলেছেন। সিটি নিউজের পাঠকের জন্য সেই আলাপচারিতার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো-
সাক্ষাতকার দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে উপস্থাপিকা শতরূপা বড়ুয়া বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে চান। বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য সার্বজনীন পেনশন বিষয়ে শতরূপার এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের সব কর্মসূচী গণমুখী। আমাদের দেশের মানুষ যেনো ভালো থাকে, তাদের জীবন যেনো সুন্দর হয়, নিরাপত্তা থাকে- সেদিকে আমরা বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়ে থাকি। আসলে আমাদের দেশের ইতিহাসটা খুব করুণ। সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের মাঝ দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে।
আমাদের জাতির পিতা একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে কেবল যাত্রা শুরু করেছিলেন তখন তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমি আমার ছোট বোন ছাড়া পরিবারের সবাইকে হারালাম। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের বিপর্যয় তখনই শুরু। এ সময়ে যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা কখনো জনগণের দিকে ফিরে তাকায়নি। সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, ভোট চুরি, ভোট কেন্দ্র দখল, নানা ধরণের অত্যাচার চলতো। কিন্তু মানুষের কল্যাণের কাজ করেনি। আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমবার এসে বয়স্কভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা- এ ধরণের সামাজিক নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন কাজ শুরু করে।
সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার লক্ষ্য সবসময় আমাদের থাকে। মূলত বয়স্ক মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই আমরা এ কর্মসূচী গ্রহণ করি। বয়স্ক মানুষ যাতে ভালোভাবে থাকতে পারেন এটাই আমাদের লক্ষ্য।
র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা- সেটা যেনো তুলে নেওয়া হয় সে জন্য র্যাবে কি সংস্কার করেছেন এবং আগামীতে কি পরিকল্পনা রয়েছে এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন- যখন জঙ্গীবাদ খুব বেশি শুরু হলো তখন আমেরিকার পরামর্শে র্যাব গঠন করা হয়। তাদের ট্রেনিংসহ সবকিছু আমেরিকার করা। যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলো তখন র্যাবের ওপর কেনো নিষেধাজ্ঞা জারি হলো তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। বরং এর আগে তাদের যে ভূমিকা তা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর র্যাবের কোনো অফিসার যদি অপরাধ করে তাদের বিচার হয়। তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসি। এমন ঘটনা অন্য দেশে নেই। এমনকি আমেরিকাতেও নেই। আমাদের দেশের আইনের এই শাসনটা বলবৎ আছে। কিন্তু হঠাৎ করে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো।
সন্ত্রাস দমনে র্যাবের ভালো একটা ভূমিকা আছে। আমাদের এক প্রতিমন্ত্রীর মেয়ে জামাই একটা অপরাধ করেছিল, সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাকে জেলে দেওয়া হয়েছে, তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সে শাস্তি পেয়েছে।
সংস্কার বিষয়ে আমি বলবো- আমাদের আইনের শাসন আছে। কেউ যেনো বিনা অপরাধে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সে ব্যাপারে আমরা সজাগ। আওয়ামী লীগ আসার পর থেকে এটা আরো বেশি কার্যকর। তারপরও কেনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো তা আমরা বুঝে উঠতে পারিনি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ থেকে সাংবাদিক এবং নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য পদক্ষেপ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটা শুধু বাংলাদেশ না, এটা পৃথিবীর সব দেশে আছে। আমেরিকাতেও আছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছিলাম। বাংলাদেশে এখন বেশি সংখ্যক মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ১৩ কোটি মানুষ মোবাইল সিম ব্যবহার করে। এখানে সাংবাদিক বলে কোনো কথা না। কিভাবে বোমা বানাতে হবে, কিভাবে খুন করতে হবে অনলাইনে এসব শিক্ষা দিচ্ছে। এসব বন্ধ করা দরকার। আমি মনে করি আন্তর্জাতিকভাবেই এদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত।
পৃথিবীর সব দেশে ডিজিটাল আইন রয়েছে, বাংলাদেশেও সেভাবে রয়েছে। তারপরও আমরা এ ব্যাপারে যথেষ্ঠ সজাগ। একটা সময় আমাদের দেশে কোনো সমন ছাড়াই যে কোনো সাংবাদিককে গ্রেফতার করা যেতো। আমরা সেগুলো বন্ধ করেছি। সাংবাদিকদের যে হয়রানি করা হয় বিষয়টা তেমন না। এখানে যে কেউ অসামাজিক কার্যক্রম অথবা কোন উস্কানিমূলক কার্যক্রম বা কোনো জঙ্গীবাদী কার্যক্রম করে তাদের বিরুদ্ধে সাধারণত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ডিজিটাল আইন যেটা আছে সেটা কখনো অপপ্রয়োগ হয় না।
সংস্কার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমেরিকার ডিজিটাল আইনে, ইংল্যান্ডের আইনে, ইউরোপের অন্য দেশে কি আছে সেটা আমরা দেখছি। আমাদের তুলনায় তাদের আইনে কোনো কঠিন শাস্তি থাকলে সেটাও আমরা সংস্কার করবো। আমেরিকার আইনটাকেই আমরা দেখছি।
নির্বাচনের জন্য বিএনপি একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের জন্য আন্দোলন করছে। এ ব্যাপারে বিএনপির নেতাদের সঙ্গে আলোচনার কোনো চিন্তা ভাবনা কি আপনাদের আছে- এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বলেন- আমরা বারবার বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করেছি। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও করেছি। বিএনপি এমন একটা রাজনৈতিক দল- এ দলটা তৈরি করেছেন একজন মিলিটারি ডিক্টেটর। যে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। ক্ষমতায় আসার পর জিয়াউর রহমান একটা রাজনৈতিক দল গঠন করে। হ্যাঁ বা না ভোটের একটা নাটক করে। ক্ষমতায় বসে রাজনৈতিক দল গঠন করে। মনে রাখতে হবে অস্ত্র হাতে নিয়ে, ক্ষমতা দখল করে, ক্ষমতায় বসে থেকে যে রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করা হয়েছে সেটাই বিএনপি। বিএনপি সৃষ্টির পর ৭৯ সালে যে নির্বাচন হয় তা ছিল কারচুপি। ভোট কারচুপির উদাহরণ তারা তৈরি করলো।
আমাদের দেশের গণতন্ত্রের ইতিহাস খুব করুণ। জনগণের সমস্ত ক্ষমতা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি ছিল। এটা হলো বাস্তবতা। একুশ বছর আমাদের দেশের মানুষকে এভাবে ভুগতে হয়েছে। তারপর যেহেতু তারা একটা রাজনৈতিক দল তারা নির্বাচন করবে।
আমি একটা দৃষ্টান্ত দিই -২০০৮ সালে যখন নির্বাচন হয় সে সময় কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সে নির্বাচনে আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার করে ক্ষমতা দখল করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি কিন্তু আমাদের। কারণ, বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্এরুয়ারি একটা নির্বাচন করে। সর্বত্র সেনাবাহিনী মোতায়েন করে পুরো নির্বাচনটা তারা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। চার পাঁচ পারসেন্ট ভোট হতো না, ভোটারকে যেতে হতো না। তাদের লোক ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সিল মারতো। যতবার মিলিটারি এসেছে ততবারই এভাবে নির্বাচন হয়েছে। আমরাই কিন্তু জনগণের ভোটাধিকারের আন্দোলন করেছি। এভাবে গণতান্ত্রিক ধারাকে একটা জায়গায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে তারা সেটাকে নষ্ট করে দেয়। যেহেতু ভোট চুরি করেছিল, সেহেতু ৩০ মার্চ খালেদা জিয়া পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এরপর ২০০১ সালে তারা ক্ষমতায় আসে। তাদের আমলে করাপশন বাড়ে, জঙ্গীবাদ সৃষ্টি হয়,
এমনকি সারা বাংলাদেশে একই দিনে ৫০০ জায়গায় বোমা হামলা হয়। আমাদের ওপর তো গ্রেনেড হামলা হয়। তার কোনো বিচার হয়নি। কোনো আলামতও রাখতে দেয়নি। যেমনটা আমার বাবার খুনীদের বিচার না করে ইনডেমনিটি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলার পরও একই ঘটনা ঘটলো। এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার দিয়ে ভোটার তালিকা করা হলো। সেই ভোট জনগণ মানেনি। তাদের অপকর্মের কারণে দেশে আবার জরুরি অবস্থা জারি হয়। আমি বিরোধী দলে থাকা সত্ত্বেও আমাকে আগে অ্যারেস্ট করা হয়। সাধারণত এমন অবস্থায় যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু ওই সময়ের সরকার আমাকে আগে গ্রেফতার করে। যাহোক জনগণ ওই অস্বাভাবিক অবস্থা মেনে নেয়নি। জনগণের চাপে কেয়ারটেকার সরকার বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচন নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ নেই। ৩০০ আসনের মধ্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ২৯টি আসন পেয়েছিল। বাকি আসন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট আমরা পেয়েছিলাম। এটা থেকেই জনগণের কাছে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে ২০১৪ নির্বাচনে অংশ নেবে না। নির্বাচনকে প্রতিহত করবে। এ জন্য তারা অগ্নি সন্ত্রাস শুরু করলো। বাসে, লঞ্চে, ট্রাকে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়েছে। তিন হাজার আটশ গাড়িতে তারা আগুন দেয়। ২৯টি ট্রেনে আগুন দেয় তারা। পাঁচশ স্কুল তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এভাবে তারা নির্বাচন বন্ধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা কিছু করতে পারেনি। আমরা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসি। আসলে ক্ষমতায় থেকে যে দল সৃষ্টি হয় তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা থাকে।
২০১৮ সালে তাদের সঙ্গে আমি আলোচনা করলাম। ইলেকশনে আসবে, আসলো। বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থা যদি দেখেন তাদের যিনি নেতা ছিলেন তিনি দূর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। এ মামলা কিন্তু আওয়ামী লীগ করেনি।
তারেক রহমান কিন্তু আর রাজনীতি না করার মুচলেকা দিয়েছিল। তখন তাকে সরকার ছেড়ে দেয় এবং সে ইংল্যান্ডে চলে আসে। সেখান থেকেই সে এখন রাজনীতি করে। তার মা সাজাপ্রাপ্ত আসামী। তাদের গঠনতন্ত্রে লেখা আছে সাজাপ্রাপ্ত আসামী দলের নেতৃত্বে থাকতে পারবে না। তাহলে এখন বিএনপি যে রাজনীতি করবে তাহলে তাদের নেতা কে? অথচ সাজাপ্রাপ্ত আসামী নিয়েই তারা রাজনীতি করে। তাহলে জনগণ তাদের ওপর বিশ্বাস রাখবে কি করে?
আমি ৮১ সালে দেশে ফিরে বিচার চাইতে পারিনি, মামলা করতে পারিনি। ১৫ আগষ্ট আমার পরিবারের ১৮ জন হত্যার শিকার হয়, সে সময় একটা মামলা করার কারো অধিকার ছিল না। যখন আমরা সরকারে এসেছি, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করতে চেয়েছি তখনো বাধা দেওয়া হয়েছে। এরপর যখন মামলা হয়েছে, যেদিন মামলার রায় হবে সেদিন বিচারক যেনো কোর্টে যেতে না পারে সেজন্য বিএনপি হরতাল ডেকেছে। ওই অবস্থা থেকে আমাকে বের হয়ে আসতে হয়েছে। অথচ দেশের স্বার্থে গণতন্ত্রের স্বার্থে আমি তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। ২০১৮ নির্বাচনে এক এক আসনের বিপরীতে একাধিক নোমিনেশন দেয়। একজন লন্ডন থেকে পাঠায়, আবার ঢাকা থেকে কেউ দেয়। এভাবে এক এক আসনে একাধিক প্রার্থী হওয়ায় যখন দেখে নির্বাচন করার অবস্থা নেই তখন এক সময় তারা নির্বাচন থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। তারপর নির্বাচনকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করে।
এখন তারা কেয়ারটেকার চায়। অথচ কেয়ারটেকার ব্যবস্থা তারা নষ্ট করে দিয়েছে। খালেদা জিয়া নিজেই বলেছে, পাগল ও শিশু ছাড়া নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ কেউ নাই। তাহলে এখন তারা কেন সেই দাবি করে- সেটাই বড় প্রশ্ন। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে- তাদের সঙ্গে কিভাবে আলোচনা করবো?
একে তো সাজাপ্রাপ্ত আসামী। তারপর আবার আমার বাবা মা ভাইবোনদের খুনী। দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে তাদের সঙ্গে অনেক উদারতা দেখিয়েছি। তবে এখন আর তাদের সঙ্গে কথা বলার মতো কিছু নেই। কারণ তারা আমার ২১ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। তাদের আগুনে যারা পুড়ে মারা গেছে, আর যারা আগুনে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পর বেঁচে আছে তাদের ওই অবস্থা যদি কেউ চোখে দেখে তখন ওদের সাথে আর বসতে ইচ্ছা হয় না। ওদের সাথে বসলে যেনো সেই পোড়া মানুষগুলোর গন্ধ আমি পাই।