• ঢাকা রবিবার
    ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামেই অগ্নিকাণ্ড, খতিয়ে দেখছে দুদক

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৮, ২০২৩, ০৪:২১ পিএম

নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামেই অগ্নিকাণ্ড, খতিয়ে দেখছে দুদক

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

দেশে গত কয়েক বছরে যেসব অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগই বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিদুর্ঘটনার ৩৮ শতাংশ ক্ষেত্রে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বিদ্যুতের মাধ্যমে। এতে প্রায় ৩৪৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

বিদ্যুতের তার দিয়ে সক্ষমতার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ সঞ্চালন, নিম্নমানের তার ও সরঞ্জাম ব্যবহার, অবহেলা ও নিয়মিত তদারকি না করাই অগ্নি দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সাম্প্রতিক সময়ে সিদ্দিকবাজার, বঙ্গবাজার ও নিউ মার্কেটে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের পর বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় করে বিদ্যুতের সরবরাহ লাইনে নিম্নমানের সরঞ্জাম ব্যবহার কিংবা রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপক ঘাটতিকে সময় অসময়ে দুর্ঘটনার বড় কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) বিদ্যুৎ খাতের কেনাকাটাসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ দাখিলের হারও বেড়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে দুদক বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে শুরু করেছে। চলছে অভিযোগের যাচাই-বাছাই ও গোয়েন্দা কার্যক্রম। শিগগিরই সরকারি কেনাকাটার দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বিশেষ টিম গঠন হচ্ছে বলে সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন সূত্র ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছে।

একই ধরনের তথ্য দিলেন দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মো. মোজাম্মেল হক খান। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, এই যে অগ্নিকাণ্ড ঘটছে, এখনো এর পেছনের কারণ উদঘাটিত হয়নি। এটা নাশকতা কিংবা বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনে নিম্নমানের সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণেও হতে পারে। তবে দুদকের প্রধান বিবেচ্য বিষয় দুর্নীতি হয়েছে কী না? বিষয়টি আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দেবো। এ বিষয়ে আমাদের কাছে কিছু কিছু তথ্য আসা শুরু হয়েছে। আমরা যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাই, যেখানে বিদ্যুৎ লাইনে নিম্নমানের উপাদান ব্যবহারের কারণে দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। একইসঙ্গে সরকারের আর্থিক অপচয় হয়েছে। বিষয়টি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে দুদক কঠোর পদক্ষেপ নেবে।

ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া তথ্যানুসারে, ২০২২ সালের অগ্নিদুর্ঘটনাগুলোতে প্রায় ৩৪৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। অগ্নিদুর্ঘটনার কারণগুলো নতুন করে সামনে আসে ঢাকায় কয়েকটি বড় অগ্নিকাণ্ডের পর। এর মধ্যে গত ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে ভয়াবহ আগুনে সেখানকার চারটি মার্কেটের ২ হাজার ৯৬১টি দোকান পুড়ে গেছে। এছাড়া মহানগর মার্কেটের ৭৯১টি, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটের ৫৯টি এবং বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্সের ৩৪টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদিও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তদন্তে আগুনের কারণ হিসেবে জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরা অথবা মশা দূর করার জ্বলন্ত কয়েলকে দায়ী করা হয়েছে। যদিও ফায়ার সার্ভিসের রিপোর্ট এখনও পাওয়া যায়নি। এছাড়া ১৫ এপ্রিল ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ২৫০টি দোকান পুড়ে গেছে। ওই আগুনের কারণ এখনো জানা যায়নি।

মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) বাধ্যতামূলক পণ্যের তালিকায় থাকা ২২৯টি পণ্যের মধ্যে বিদ্যুতের তার ও সরঞ্জাম রয়েছে। অর্থাৎ এসব পণ্য বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মান মেনে উৎপাদন ও আমদানি হচ্ছে কী না সেটা বড় প্রশ্ন। অসাধু কিছু ব্যক্তি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোগো ও সিল ব্যবহার করে নিম্ন মানের তার উৎপাদন করে বাজারে ছেড়ে দেন। স্বাভাবিকভাবে অনেক সময় ওই তার দেখে বোঝার উপায় থাকে না সেটি আসল, নাকি নকল। ঢাকায় ১ মার্চ থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস সাড়া দিয়েছে এমন অগ্নিদুর্ঘটনা ছিল ১৬টি। এর মধ্যে সাতটির কারণ জানা গেছে। যার চারটিই ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে। দুটি ঘটনা ঘটে গ্যাসলাইনের মাধ্যমে নির্গত হওয়া গ্যাস জমে।

ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদন বলছে, বিদ্যুতের তার দিয়ে সক্ষমতার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ সঞ্চালন, নিম্নমানের তার ও সরঞ্জাম ব্যবহার, অবহেলা ও নিয়মিত তদারকি না করাই অগ্নিদুর্ঘটনার প্রধান কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাদের মতে, বিদ্যুতের তার দিয়ে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ সঞ্চালিত হলে তাপে সেটি অনেক বেশি প্রসারিত হয়। তখন তারের ওপরে থাকা প্লাস্টিক আবরণ গলে স্ফুলিঙ্গ হয়। সেখান থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

ফায়ার সার্ভিস অগ্নিদুর্ঘটনার আরও কিছু কারণ খুঁজে পেয়েছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, আগুনের ঘটনার দ্বিতীয় বড় কারণ বিড়ি ও সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা। ২০২২ সালে ১৬ শতাংশের কিছু বেশি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে এ কারণে। প্রায় ১৪ শতাংশ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে চুলা থেকে। সেটি বৈদ্যুতিক, গ্যাস বা মাটির চুলা হতে পারে। গ্যাস সরবরাহ লাইনও আগুনের ঘটনার উল্লেখযোগ্য কারণ। ২০২২ সালে ৩ শতাংশের কিছু বেশি আগুনের ঘটনা ঘটেছে গ্যাস সরবরাহ লাইন থেকে।

বৈদ্যুতিক গোলযোগ, বিড়ি ও সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা, চুলা ও গ্যাসের লাইন থেকে ৭১ শতাংশ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে ২০২২ সালে। এর বাইরে ছোটদের আগুন নিয়ে খেলা, উত্তপ্ত ছাই বা জ্বালানি, খোলা বাতির ব্যবহার, যানবাহনের দুর্ঘটনার আগুন ইত্যাদি অগ্নিদুর্ঘটনার কারণ। সব মিলিয়ে কারণ পাওয়া গেছে ১৯টি। তবে ফায়ার সার্ভিসের হিসাবে ৪ হাজার ৯১টি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কারণ অজ্ঞাত বা অন্যান্য উল্লেখ করা হয়েছে।

তিন বিদ্যুৎ প্রকল্পে ৩৯০ কোটি টাকার দুর্নীতি

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গবেষণায়ও ভয়াবহ দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে। গত বছরের ১১ মে বাংলাদেশে কয়লা ও এলএনজি বিদ্যুৎ প্রকল্প : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে কয়লাভিত্তিক তিন বিদ্যুৎ প্রকল্পে শুধু ভূমি ক্রয়, অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ প্রদানে মোট ৩৯০ কোটি ৪৯ লাখ টাকার দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করেছে। যার মধ্যে বরিশাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্নীতির পরিমাণ ১৫ কোটি ৫৯ লাখ ৯০ হাজার, বাঁশখালী এস এস বিদ্যুৎকেন্দ্রে ২৫৫ কোটি ও মাতারবাড়ী এলএনজি বিদ্যুৎকেন্দ্রে আত্মসাৎ হয় ১১৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর ওই প্রতিবেদনও গুরুত্ব দিয়ে যাচাই-বাছাই করছে বলে জানা গেছে।

 

বিএস/
 

আর্কাইভ