• ঢাকা বৃহস্পতিবার
    ০৭ নভেম্বর, ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

পালাতে পারেন আরাভ, সতর্ক নজর দুবাই পুলিশের

প্রকাশিত: মার্চ ২২, ২০২৩, ১১:০৮ পিএম

পালাতে পারেন আরাভ, সতর্ক নজর দুবাই পুলিশের

রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

গ্রেফতার এড়াতে পলাতক রবিউল ইসলাম উরফে আরাভ খান দুবাই ছাড়তে পারেন। আরাভ খানের ভারতীয় পাসপোর্টে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ভিসা রয়েছে। এই জন্য পুলিশ খুনের মামলায় দুবাই পলাতক আরাভ খানকে নজরদারিতে রেখেছে দেশটির পুলিশ।

সোমবার রাত থেকেই দুবাইয়ের একটি ফ্ল্যাটে তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির পরই দুবাই পুলিশের এনসিবি শাখা আরাভকে আটকের তৎপরতা শুরু করে। পুলিশের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ পুলিশের কেউ মন্তব্য করতে চাননি। জানতে চাইলে সংযুক্ত আমিরাতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত আবু জাফর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের কিছু জানায়নি। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে আমরা জানতে পেরেছি তাকে নজরদারি করা হচ্ছে এবং তার চলাচল সীমিত করা হয়েছে।’ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান দুবাইয়ে গ্রেফতার হননি। তবে তিনি পালিয়ে থাকতে পারবেন না বলে মন্তব্য করেন।
সূত্র জানায়, খুনের মামলাসহ ১২ মামলার পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া এবং জালিয়াতি করে ভারতীয় নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট নেয়ার বিষয়টি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নজরে এসেছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক তদন্তে জালিয়াতির সত্যতা পাওয়ার পর তার পাসপোর্ট সাসপেন্ড করেছে। ফলে ভারতীয় পাসপোর্টের মাধ্যমে দুবাইতে তার স্থায়ী বসবাসের অনুমতিও বাতিল হয়ে গেছে।


কূটনৈতিক একজন কর্মকর্তা জানান, ‘আরাভ এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবৈধ নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবেন। যেহেতু তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রেড নোটিশ জারির বিষয়টি ইন্টারপোলে নথিভুক্ত হয়েছে এবং বাংলাদেশ তাকে নিজেদের নাগরিক হিসেবে দাবি করেছে, সেহেতু সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষ তাকে অন্য অবৈধ বসবাসকারীদের মতো বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে। এ ক্ষেত্রে বন্দি বিনিময় চুক্তির কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।’ দুবাইয়ের স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, মঙ্গলবার রবিউল ওরফে আরাভকে তার জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানে দেখা যায়নি। তার মোবাইলে একাধিকবার কল দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
সূত্র জানায়, আরাভকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও পুলিশ সদর দফতরের একটি যৌথ দল দুবাই যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে। ইতোমধ্যে সরকারি আদেশ জারি করার জন্য পুলিশ সদর দফতর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। আগামী দু-এক দিনের মধ্যেই তিন থেকে চারজনের একটি দল দুবাই যেতে পারে। পুলিশ সদর দফতরের এনসিবি শাখার এআইজি শরীফ মোস্তাফিজুর রহমান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তিনি এআইজি মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। এআইজি মিডিয়া মনজুর হোসেন বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা এখনো এ বিষয়ে কোনো তথ্য পাইনি।’ এনসিবির একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘আরাভ দুবাই পুলিশের হেফাজতে আছে। তার চলাফেরাও সীমিত করা হয়েছে। দুবাইয়ের স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, আরাভকে তার বাসাতে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে।’
সূত্র জানায়, আরাভকে আটক রাখা হলেও এখন পর্যন্ত গ্রেফতার দেখানো হয়নি। এর কারণ আরাভকে গ্রেফতার করার পর পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা কী হবে, তাকে আদৌ বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে কি না, তা দেশটির নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের বিষয়। কারণ সূত্রের তথ্য মতে, দুবাইয়ে যে কেউ যে কোনো পরিমাণ বিনিয়োগ করলে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না। সেই হিসাবে আরাভকে কোন ধরনের অপরাধী হিসেবে গ্রেফতার করা হবে তা নিয়ে দুবাই পুলিশের মধ্যে সংশয় রয়েছে।’ 
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইন্টারপোলের অনুরোধে আরাভকে প্রাথমিকভাবে পুলিশি নজরদারি ও হেফাজতের মধ্যে রাখা হয়েছে। কিন্তু তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে কি না, পাঠালে কীভাবে সেটা করা হবে- এ নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টরা।


সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে গত সপ্তাহে এক জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আরাভ জুয়েলার্সের উদ্বোধন করার পর ব্যাপক আলোচনা আসে জুয়েলার্সের মালিক আরাভ খানকে নিয়ে। ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ক্রীড়া ও বিনোদন জগতের অনেক তারকাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ফেসবুকে একাধিক পোস্ট দিয়েছিলেন আরাভ খান। তখনই তাকে পুলিশ সদস্য হত্যা মামলার আসামি বলে শনাক্ত করে ফেলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। গোয়েন্দা পুলিশের তথ্যমতে, আরাভ জুয়েলার্স নামের ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক আরাভ খানের আসল নাম রবিউল ইসলাম। বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় তার বাড়ি। তিনি সোহাগ মোল্লা, হৃদয় শেখ, আপন- এ রকম কয়েকটি নামে পরিচিত। ২০১৮ সালের ৭ জুলাই ঢাকায় পুলিশের পরিদর্শক মামুন এমরান খান খুন হন। সেই খুনের আসামি হয়ে দেশ ছেড়েছিলেন রবিউল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, ওই খুনের ঘটনার পরে অন্য আসামিদের সঙ্গে আরাভকে আটক করেছিল ডিবি পুলিশ। ডিবি পুলিশ কার্যালয়ে দুদিন রাখার পর তাকে পুলিশের এক পদস্থ কর্তার অনুরোধে ছেড়ে দেয়া হয়। চার দিন ধরে বিষয়টি নিয়ে দেশের একাধিক গণমাধ্যম এসব তথ্য প্রকাশ করছে। এর পরই পুলিশপ্রধান (আইজিপি) এ বিষয়ে মুখ খোলেন।
মামলা ও নথিপত্র সূত্রে জানা যায়,  নারীদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করে বিত্তশালীদের ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেয়া একটি চক্রের কবলে পড়েন পুলিশ পরিদর্শক মামুন এমরান। এরপর তাকে ধরে নিয়ে হত্যার পর পেট্রোল ঢেলে লাশ পুড়িয়ে গাজীপুরের জঙ্গলে ফেলে দেয় হত্যাকারীরা। এ ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলায় আসামি করা হয় আরাভ খান ওরফে রবিউল ওরফে হৃদয়কে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার এই পলাতক আসামির নাম রবিউল ইসলাম ওরফে আপন। তার বাড়ি গোপালগঞ্জে। কখনো সে নাম ধারণ করে সোহাগ, কখনো বা শেখ হৃদয়। ইতোমধ্যে মামলাটি তদন্ত করে তাকে অভিযুক্ত করে চার্জশিটও দিয়েছে ডিবি। সে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ঘটনাটি ঘটিয়ে আরাভ পাসপোর্ট ছাড়া ভারতে চলে যায়। তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। 


পরে তদন্তে উঠে আসে রবিউল ইসলাম আপন নামের একজন কোর্টে আত্মসমর্পণ করেছে। তারপর তাকে জেলখানায় নেয়া হয়। কিন্তু এটা একটা ফেক ঘটনা ছিল। যে আত্মসমর্পণ করেছে সে ভুয়া। আসল আপনের সঙ্গে তার একটা যোগসূত্র বা কমিটমেন্ট হয়েছিল। জানা যায়, টাকার বিনিময়ে প্রকৃত আসামি রবিউলের পরিবর্তে জেলে যান চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার আবু ইউসুফ লিমন। যখনই তিনি জেলে গেলেন আসল আপন তাকে আর টাকা দিচ্ছিল না। তখন তিনি কোর্টে সত্য কথা বলে দেন। জানান, আমি আপন না। আপন হচ্ছে উনি, যিনি ভারতে আছেন। আমি ভুল করেছি। তখন কোর্ট আবার ডিবিকে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্তে দেখা যায়, এই আপন আসল আপন নয়। ওই আপন অবৈধভাবে ভারতে চলে গেছে। পরে সেখান থেকে সে দুবাই চলে যায়। এরই মধ্যে বাংলাদেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ গ্রহণ করেছে ইন্টারপোল। সবশেষ জানা গেছে, দুবাই পুলিশ আরাভকে খুঁজছে। অনেকে মনে করছেন গ্রেফতার এড়াতে আরাভ দুবাই ছাড়তে পারেন। আরাভ খানের ভারতীয় পাসপোর্টে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ভিসা রয়েছে। 
সোমবার চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আরাভ খানের সঙ্গে পুলিশের ঊর্ধ্বতন সাবেক কোনো কর্মকর্তার সম্পর্কের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। উপযুক্ত সময়ে আমরা তা আপনাদের জানাব।’ তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ হত্যা মামলায় যে নামে চার্জশিট হয়েছে, সেই নামে রেড নোটিশ জারির জন্য ইন্টারপোলকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। খবর এসেছে, ইন্টারপোল এটি গ্রহণ করেছে। এখন বাকি কাজ তারা করবে। নোটিশ অবশ্য ‘আরাভ খান’ নামে হবে না। পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যা মামলায় এ আসামির যে নাম আছে, সেই ‘রবিউল ইসলামের’ নামে নোটিশ জারি করতেই পাঠানো হয়েছে চিঠি।’
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি মিডিয়া মনজুর রহমান বলেন, ‘পলাতক আসামি আরাভ ওরফে রবিউল ওরফে হৃদয়কে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের মুখোমুখি করার জন্য পুলিশ সদর দফতরের এনসিবি শাখা কাজ করছে। সে যাতে অন্য কোথাও যেতে না পারে সে বিষয়টিও ইন্টারপোলকে অবহিত করা হয়েছে।’ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আরাভের বিষয়ে বাংলাদেশে অবস্থিত দুবাই দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ চলমান রয়েছে। আরাভের পেছনে কারা জড়িত রয়েছে এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্তের প্রয়োজনে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানসহ অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।’

২০১৮ সালের ৭ জুলাই রাজধানীর বনানীর একটি ফ্ল্যাটে খুন হন পুলিশ পরিদর্শক মামুন। তাকে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কথা বলে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের পর আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম ভারতে পালিয়ে যান। এই মামলায় ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল রবিউলসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেয় গোয়েন্দা পুলিশ। মামলায় রবিউলের ভাড়া করা এক ব্যক্তি আত্মসমর্পণ করে ৯ মাস জেল খেটে বের হন। ২০২০ সালে রবিউল ভারতীয় পাসপোর্ট পান। সেখানে তার নাম বদলে লেখা হয় ‘আরাভ খান’। সেখান থেকে চলে যান দুবাই। ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর আরব আমিরাত সরকার তাকে রেসিডেন্ট পারমিট দেয়। রবিউল এখন সেখানেই আছেন।

 

আরিয়ানএস/এএল

আর্কাইভ