প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৩, ০৮:০২ পিএম
চলতি বছর (২০২৩) হজযাত্রীদের প্লেনভাড়া এক লাফে ৩০ শতাংশ বাড়িয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এখন একজন হজযাত্রীর ঢাকা-সৌদি-ঢাকা রুটে প্লেনভাড়া লাগবে এক লাখ ৯৮ হাজার টাকা। অথচ এক বছর আগে এই রুটে জনপ্রতি টিকিটের দাম ছিল এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। গত সাত বছর ধরে নিয়মিত টিকিটের দাম বাড়িয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত এই সংস্থাটি। ফলে অনেকের হজযাত্রা থেকে যাচ্ছে ‘স্বপ্ন’। আর যারা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তারা পড়ছেন আর্থিক চাপে। তবে বিমান কর্তৃপক্ষ বলছে ভিন্ন কথা। তারা জেট ফুয়েলের দাম বাড়ার কথা বলছে। আর এ বিষয়টিকে ‘অজুহাত’ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
হজ ফ্লাইটে ৩০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স
এবার হজ প্যাকেজ ছয় লাখ ৮৩ হাজার ১৫ টাকা
প্লেনভাড়াসহ হজ প্যাকেজের দাম পুনর্বিবেচনার দাবি
বিমান ভাড়া বাড়ানো যৌক্তিক: শফিউল আজিম
এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) ও হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) অভিযোগ হলো, বিমান দেনায় জর্জরিত একটি সংস্থা। এখন সংস্থাটি অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এমন অবস্থায় তারা হজযাত্রীদেরও ছাড় দিচ্ছে না। ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে মুনাফা করছে।
আটাব সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে সৌদিতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্লেনের জনপ্রতি ভাড়া ছিল এক লাখ ১৮ হাজার ৭৩৭ টাকা। এর এক বছর পর, ২০১৮ সালে ভাড়া বাড়ে ৯ হাজার ৯১৩ টাকা। ২০১৯ সালে ভাড়া ছিল এক লাখ ২৮ হাজার টাকা। পরের বছর ২০২০ সালে একই রুটে ১০ হাজার টাকা ভাড়া বাড়ানো হয়। তবে করোনার কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে সৌদিতে হজযাত্রী পরিবহন বন্ধ ছিল। পরে ২০২২ সালে হজ ফ্লাইটের খরচ ধরা হয় এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। সবশেষ চলতি বছর এক লাফে ৫৮ হাজার টাকা ভাড়া বাড়ায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এই হিসাবে চলতি বছর ঢাকা-সৌদি-ঢাকা রুটে প্লেনভাড়া বেড়ে হয়েছে এক লাখ ৯৮ হাজার টাকা।
এবার প্লেনভাড়া এক লাখ ৯৮ হাজার টাকা করা হয়েছে। ফলে অনেকের হজযাত্রা থেকে যাচ্ছে স্বপ্ন
এদিকে প্লেনভাড়াসহ হজ প্যাকেজের দাম কমাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করেছে আটাব। সংস্থাটির দাবি, এক লাফে ৩০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্লেনভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারিত করা হলে হজযাত্রীদের আর্থিক ও মানসিক চাপ অনেকটাই কমবে। তাই প্লেনভাড়া কমানোসহ প্যাকেজ মূল্য পুনর্বিবেচনা করতে হবে। একই দাবি জানিয়েছেন হাব সংশ্লিষ্টরা।
ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি বছর সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫ হাজার ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এক লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জন পবিত্র হজ পালন করবেন। এরমধ্যে নিজস্ব প্লেনের মাধ্যমে ৫০ শতাংশ হজযাত্রী পরিবহন করবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। বাকি ৫০ শতাংশ যাত্রী সৌদি ও ফ্লাইনাস এয়ারলাইন্স বহন করবে। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২৮ জুন অনুষ্ঠিত হবে পবিত্র হজ।
প্লেনভাড়ার বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতি বছর এককভাবে ৫০ শতাংশ হজযাত্রী পরিবহন করে বিমান। তারাই নিজের ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ায়। তখন তাদের সঙ্গে অনেকটা মিল রেখে ভাড়া নির্ধারণ করে সৌদি এয়ারলাইন্স। এবার যে হারে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ভাড়া নির্ধারণ করেছে, তাতে দেখা যায়, সব খরচ বাদ দিয়ে এক-তৃতীয়াংশ লাভ হবে। বিমান যদি লাভের চিন্তা বাদ দিয়ে শুধু খরচের টাকা নেয়, তাহলে স্বস্তি পেতেন হজযাত্রীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভিন্ন কথা বলেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শফিউল আজিম। বুধবার (২২ ফেব্রুয়ারি) তিনি মুঠোফোনে বলেন, প্লেন তেলে চলে, পানিতে নয়। এখন বিশ্বে জেট ফুয়েলের দাম বেড়েছে, বাংলাদেশও তার বাইরে নেই। তাই প্লেনভাড়া বাড়ানো যৌক্তিক। বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্লেনভাড়া গড়ে ৪০ শতাংশ বেড়েছে। সেই তুলনায় আমরা মাত্র ৩০ শতাংশ বাড়িয়েছি।
দেশে খাদ্যপণ্য, বাড়িভাড়াসহ সব কিছুর দাম বেড়েছে, সেগুলো নিয়ে প্রতিবেদন না লিখে সাংবাদিকরা শুধু প্লেনভাড়া নিয়ে পড়ে রয়েছেন- এমন কথা বলে মুঠোফোনের সংযোগ কেটে দেন শফিউল আজিম।
প্লেনভাড়া পুনর্বিবেচনার দাবি আটাবের
এদিকে প্লেনভাড়াসহ হজ প্যাকেজের দাম পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর আবেদন করেছে এসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)। ১৪ ফেব্রুয়ারি এই আবেদন করা হয়।
এতে বলা হয়, ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে হজযাত্রীদের প্লেনভাড়া ক্রমাগত বেড়েছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে এসে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। প্লেনভাড়া বাড়ায় বেড়েছে হজ প্যাকেজের মূল্য। বর্তমানে সৌদি রিয়ালের মূল্য হিসাব করে খরচ নির্ধারণ করা হলেও দেখা গেলো, হজের সময় রিয়ালের দাম বেড়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে টাকা খরচও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আটাব সভাপতি এস এন মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, বিশ্বে আর্থিক মন্দার কারণে ডলার সংকট রয়েছে। তার প্রভাব পড়ছে হজযাত্রীদের ওপর। তারা আর্থিকভাবে চাপে রয়েছেন। ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ থেকে হজ করতে যাওয়ার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলবেন অনেকে। প্লেনভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারিত করা হলে হজযাত্রীদের আর্থিক ও মানসিক চাপ অনেকটাই কমবে।
হজ প্যাকেজের মূল্য ক্রমাগতভাবে বাড়ছে
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০১৫ সালে হজের সর্বনিম্ন খরচ ছিল দুই লাখ ৯৬ হাজার ২০৬ টাকা। ২০১৬ সালে তা হয় তিন লাখ চার হাজার টাকা। এরপর ২০১৭ সালে তিন লাখ ১৯ হাজার টাকা হয় সর্বনিম্ন প্যাকেজ। ২০১৮ সালে এসে তা হয় তিন লাখ ৩১ হাজার টাকা। ২০১৯ সালে তিন লাখ ৪৫ হাজার টাকা। মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে হজে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ ছিল। পরে ২০২২ সালে এসে হজ প্যাকেজের মূল্য হয় পাঁচ লাখ ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা। চলতি বছর তা বাড়িয়ে ছয় লাখ ৮৩ হাজার ১৫ টাকা করে ধর্ম মন্ত্রণালয়।
এ অবস্থায় প্লেনভাড়াসহ হজ প্যাকেজের দাম কমানোর দাবি জানিয়েছে হাব। সংগঠনটির এক নেতা বলেন, প্রতি বছর জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ভ্যাট-ট্যাক্স বৃদ্ধি, ডেডিকেটেড হজ ফ্লাইটসহ নানা অজুহাতে ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব করে বিমান। ওই প্রস্তাবিত ভাড়ার আলোকেই নির্ধারণ হয় ভাড়া। তারপর হজ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। তবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সারা বছরের লোকসানের ধকল কাটিয়ে ওঠে হজ ফ্লাইটের মুনাফা থেকে। হজ ফ্লাইট থেকে বিমান ৮০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত মুনাফা করে। বিমান বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১০-২০ কোটি টাকা মুনাফা রেখে ভাড়া প্রস্তাব করলে হজযাত্রীদের ওপর আর্থিক চাপ কমবে।
বিমানবন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি প্লেন
হাবের সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম বলেন, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে হজের ব্যয় বেড়েছে তিন লাখ ৩৮ হাজার ১৫ টাকা। অথচ এবছর হজের আনুষঙ্গিক ব্যয় কমিয়েছে সৌদি সরকার। প্লেনভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে ভাড়া নির্ধারণে স্বতন্ত্র কমিটি গঠন করতে হবে।
তিনি বলেন, এভিয়েশন খাতের বিষয়ে যারা বোঝেন, তাদের সমন্বয়ে একটি স্বতন্ত্র টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করতে পারে সরকার। এই কমিটি সব ধরনের খরচ, সব কিছু বিবেচনা করে ভাড়া নির্ধারণ করবে। বিমানের একক প্রস্তাবে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে ওই কমিটির প্রস্তাবের ভিত্তিতে ভাড়া নির্ধারণ হবে। কেবল বিমানের প্রস্তাবিত হারে ভাড়া নির্ধারিত হতে পারে না।
জানতে চাইলে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মতিউল ইসলাম বলেন, কোনো অবস্থায়ই আমরা হজের খরচ বাড়াতে চাই না। কিন্তু এবার সৌদি রিয়ালের দাম বাড়ায় ব্যয় বেড়েছে। এছাড়া জেট ফুয়েলের দাম বাড়ায় টিকিটের দাম বাড়িয়েছে বিমান। সব মিলিয়ে হজ প্যাকেজ তৈরি করা হয়েছে। এখানে মন্ত্রণালয়ের তেমন কিছু করার থাকে না।
সাজেদ/