প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৯, ২০২৩, ০৬:১১ পিএম
ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই ছিল ইভার মূল টার্গেট। দেশের নামী দামি তারকা হোটেলে ও বারে ছিল তার অভিসার। অভিজাত এলাকার এসব হোটেল কিংবা বারে যত খরচ হতো তার একটি টাকাও বহন করতে হতো না তাকে। যার খরচ বহন করতো ধনীরা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবিপ্রধান) হারুন অর রশীদ বলেছেন, ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই প্রতারক ইভার মূল টার্গেট ছিলেন। সম্প্রতি গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা জানান তিনি।
ডিবিপ্রধান জানান, কাগজে-কলমে ১০টির অধিক বিয়ে করেছেন ইভা এবং ১০০’র অধিক পুরুষের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে তাদের ব্ল্যাকমেইলিং করে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তারা দেশে প্রতারণার রাজ্য গড়ে তুলেছে। সরকারি কর্মকর্তা এমন ২০ থেকে ২৫ জন আছেন যাদের তিনি প্রতারিত করেছেন।
ফেসবুকে সম্পর্ক হওয়ার পর কোনো তারকা হোটেল কিংবা বারে সাক্ষাৎ করেন তারা। টার্গেট ব্যক্তিকে মাতাল করার পর ধারণ করা হয় ভিডিও। পরে সেসব ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে শুরু হয় ব্ল্যাকমেইলিং। ইভার ফাঁদে পা দিয়ে শতাধিক ব্যক্তি খুঁইয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এ তালিকায় রয়েছেন দুই ডজনেরও বেশি সরকারি কর্মকর্তাও। গ্রেফতারের পর গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত তানজিনা আক্তার ওরফে ইভার দশটি বিয়ের তথ্য পাওয়া গেছে।
ডিবিপ্রধান জানান, ধনাঢ্য ব্যক্তিদের টার্গেট করেন ইভা আর বন্ধুত্ব হয় ফেসবুকে। মেসেঞ্জারে পাঠান নিজের আপত্তিকর ছবি এবং ভিডিও। সম্পর্ক হওয়ার পর কোনো তারকা হোটেলে করেন সাক্ষাৎ। সেখানে টার্গেট ব্যক্তিকে মাতাল করার পর ধারণ করা হয় ভিডিও। পরে সেসব ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে শুরু হয় ব্ল্যাকমেইলিং। এমন অসংখ্য অভিযোগের পর তাকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করেছে রাজধানী থেকে। গত ১১ জানুয়ারি মাসুম বিল্লাহ ফারদিন ওরফে রাজুকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেয়া তথ্যে জানা যায় তানজিনা আক্তার ইভা সম্পর্কে।
ইভা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টিকটক, স্ন্যাপচ্যাটসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাউন্ট খুলতো। এসব অ্যাকাউন্টে তার অর্ধ নগ্ন ছবি পোস্ট করে বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতো। তারপর ম্যাসেঞ্জারে নক দিতো। কথাবার্তার এক পর্যায়ে তাদের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর নিতো। নিজেকে কুমারী বলে পরিচয় দিয়ে গুলশানের বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে লাঞ্চ ও ডিনারের জন্য তাদেরকে দাওয়াত দিতো। দেখা করার পর ঘনিষ্ঠতা বাড়াতো। টার্গেট ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যে প্লাটফর্মই ব্যবহার করুক না কেন অধিকতর নিরাপত্তার কথা বলে তাদের দিয়ে স্ন্যাপচ্যাটে একাউন্ট খুলিয়ে নিতো। যার স্ন্যাপচ্যাটে একাউন্ট রয়েছে তাকে স্ন্যাপচ্যাটের ম্যাসেঞ্জারে তার নিজের অর্ধনগ্ন নগ্ন ছবি পাঠিয়ে অন্তরঙ্গ কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করতো। যাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ কথা বলতো তাদের কথোপকথনের রেকর্ড সংরক্ষণ করে রাখতো। সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার জন্য টার্গেটদের সঙ্গে হোটেলে রাত্রিযাপন করতো। সম্পর্কের ফাঁদে ফেলে মোটা অংকের টাকা সুকৌশলে হাতিয়ে নিতো। টার্গেটদের বিভিন্ন নাইট পার্টি, স্পা সেন্টার এবং বারে নিয়ে যেতো। সেখানে নিয়ে তাদের বিভিন্ন অনৈতিক কাজে আকৃষ্ট করে নিজের স্বার্থ হাসিল করতো। তার মোহনীয় মায়ায় আকৃষ্ট করে প্রতারণার ফাঁদে ফেলতো। তার ফাঁদ থেকে বাদ যায়নি সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, নেতা, উচ্চ পদস্থ চাকরিজীবীরা। এরকম ১০ জনকে সাময়িক সময়ের জন্য বিয়ে করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তার ব্লাকমেইলের শিকার এমন শতাধিক ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। যাদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে টাকা হাতিয়েছে। যাদের সঙ্গে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে নিজেকে মোহনীয় রূপে উপস্থাপন করে আকৃষ্ট করার মাধ্যমে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতো।
ডিবি জানায়, ইভার পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় ২০০৩ সালে এক প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি চাকরিজীবীর সঙ্গে। উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনের জন্য তার প্রথম স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হয় ২০১০ সালে। তারপর লাগামহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে ইভা। প্রথম স্বামীর ঘরে তার তিনটি সন্তান থাকলেও ইভা তাদেরকে নিজের সন্তান বলে পরিচয় দেয় না। প্রথম স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্সের আগেই সে একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং তাদেরকে প্রতারিত করে। এভাবেই সে একে একে দশটি বিয়ে করে এবং প্রতারণার মাধ্যমে শতাধিক ব্যক্তির সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। তার দেশে বিদেশে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে একসঙ্গে রাত্রিযাপনের তথ্য পাওয়া গেছে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ৫টি মামলা আছে। এ ছাড়া অসংখ্য ধনাঢ্য ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন।
এদিকে ইভার সহযোগী রাজু নিজেকে গাজীপুর-৩ আসনের সাবেক এমপি রহমত আলীর দ্বিতীয় ঘরের সন্তান পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন হাই প্রোফাইল ব্যক্তির সঙ্গে ছবি তুলে ফেসবুক আইডি থেকে পোস্ট করতো। অর্ধশতাধিক ভুয়া পরিচয়ে ফেসবুক আইডি তৈরি করে টার্গেট ব্যক্তিদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতো। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করার পর হাই/হ্যালো দিয়ে শুরু করে আলাপচারিতা। এমপির দ্বিতীয় ঘরের সন্তান পরিচয় দিয়ে টার্গেট ব্যক্তিকে বিদেশ পাঠানো, সরকারি চাকরিতে নিয়োগ, বদলিসহ বিভিন্ন কাজ সহজে করে দেয়ার প্রলোভন দেখাতো। বিশ্বাস স্থাপন করার জন্য বিভিন্ন হাইপ্রোফাইল ব্যক্তির সঙ্গে তোলা ছবি এডিট করে ম্যাসেঞ্জারে পাঠাতো। এ ছাড়াও সে টার্গেট ব্যক্তির দুর্বলতা বুঝতে পেরে সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরের কাগজপত্র ফেসবুক থেকে ডাউনলোড করে সফটওয়্যারের মাধ্যমে এডিট করে নিজেকে হাইপ্রোফাইল প্রমাণ করার জন্য নিজের নাম ও ইচ্ছেমতো পদবী বসিয়ে ম্যাসেঞ্জার/হোয়াটসঅ্যাপে টার্গেট ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে দিতো। বিশ্বাস স্থাপনের জন্য সে ব্যাংক একাউন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতারণার টাকা গ্রহণ করে।
ডিবি জানায়, রাজু ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানের হোটেলের বার বা পার্টিতে বিভিন্ন ব্যক্তিদের সঙ্গে মিথ্যা পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার উদ্দেশ্যে যাতায়াত করে। তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন করে। এক পর্যায়ে তাদের সঙ্গে ছবি তোলে ফেসবুকে প্রচার করে। বিভিন্ন চ্যানেল এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হওয়ার জন্য নিজেকে ইয়াং স্টার হিসেবে পরিচয় দেয় এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা ব্যক্তিগত সম্পর্কের ছবি দেখায়।
সে মিডিয়াতে আমন্ত্রিত হয়ে অনর্গল মিথ্যা কথা বলে। মিডিয়াতে সাক্ষাৎকারের সময় বিভিন্ন স্টেজ পারফর্মের জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া গমন করেছে বলে জানায়। যদিও তদন্ত সংশ্লিষ্টরা তার কোনো পাসপোর্ট খোঁজে পাননি। সে যখন যে পরিচয় প্রদান করে সুবিধা গ্রহণ করা সম্ভব সেই পরিচয়ই দিতো। প্রতারণার সুবিধার জন্য ঢাকার এবং কক্সবাজারের নামি দামী হোটেলে বসবাস করে।
ডিবি জানায়, ২০২২ সালের প্রথম দিকে রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলের বারে রাজুর সঙ্গে পরিচয় হয় ইভার। বিভিন্ন সময় দেখা সাক্ষাৎ ও কথা বলার মাধ্যমে তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। বিভিন্ন হোটেলে তারা একাধিকবার রাত্রি যাপন করে। প্রতারক ইভা এবং রাজু একে অপরকে সহযোগিতায় তাদের প্রতারণা বিস্তৃত করে। রাজু বিভিন্ন প্রতারিত ব্যক্তির কাছে তানজিনা ইভাকে পুলিশের গাজীপুর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসাবে পরিচয় দিতো। জানাতো ইভাকে সে বিয়ে করেছে। রাজু তার হোয়াটসঅ্যাপ থেকে ইভাকে কল দিয়ে কথা বলিয়ে দিয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে। প্রতারণায় যেমন দুজন দুজনকে সহযোগিতা করতো ঠিক প্রতারণায় অর্জিত টাকাও তারা ভাগবাটোয়ারা করে নিতো।
ফারদিন এবং ইভাকে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ বলে জানান হারুন অর রশীদ।
ফারদিন এবং ইভার কাছ থেকে এ রকম আরও অনেকের নাম পাওয়া গেছে, তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলমান আছে বলেও জানান তিনি।
এনএমএম/এএল