• ঢাকা শুক্রবার
    ০৮ নভেম্বর, ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

শান্তি আসবে না জেনেও দেওয়া হয়েছিল যে নোবেল শান্তি পুরস্কার

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৩, ২০২৩, ১২:৫২ এএম

শান্তি আসবে না জেনেও দেওয়া হয়েছিল যে নোবেল শান্তি পুরস্কার

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

ভিয়েতনামে যুদ্ধের ময়দান থেকে মার্কিন বাহিনীকে ফিরিয়ে আনায় ভূমিকা রেখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। ভিয়েতনামের জেনারেল, কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ লে ডাক থো-কে সঙ্গে নিয়ে ১৯৭৩ সালে প্যারিস শান্তি চুক্তি করেছিলেন তিনি। এই চুক্তির জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হন তারা।

থো পুরস্কার নিতে অস্বীকৃতি জানালেও কিসিঞ্জার তা ঘরে নিয়েছিলেন। বিতর্ক ওঠায় পরে আবার পুরস্কার ফিরিয়েও দিতে চেয়েছিলেন তিনি। সেই পুরস্কার নিয়ে নতুন তথ্য প্রকাশিত হয়েছে এবার।

নোবেল পুরস্কার মনোনয়ন সংক্রান্ত তথ্য ৫০ বছর গোপন রাখার নিয়ম রয়েছে। এই সময় পার হয়ে যাওয়ায় সম্প্রতি এক আবেদনে সাড়া দিয়েছে নোবেল কমিটি। হেনরি কিসিঞ্জারকে মনোনয়ন দেওয়া সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেছে তারা।

জানা গেছে, কিসিঞ্জারের প্রচেষ্টা ‍‍`শান্তি আনতে পারবে না‍‍` এ রকম আশঙ্কা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত থাকার পরও পুরস্কারের জন্য তাকে বাছাই করা করা হয়। শুধু তাই নয়, লে ডাক থো সম্পর্কে বিশদ কিছু জানতেন না তার নাম প্রস্তাবকারীরা।

প্যারিস চুক্তির জন্য শুধু কিসিঞ্জারকে পুরস্কার দেওয়াটা যথার্থ মনে হয় না, এই চিন্তা করেই তারা থো এর নামও জুড়ে দেন। প্যারিস চুক্তিতে হ্যানয়ের (তৎকালীন দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী) প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন থো। ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত চলে ভিয়েতনাম যুদ্ধ।

সোভিয়েত রাশিয়া ও চীন সমর্থিত কমিউনিস্টপন্থি উত্তর ভিয়েতনাম ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে দুই দশক ধরে চলে এই রক্তক্ষয়ী সংঘাত। শুরু থেকেই স্নায়ু যুদ্ধের অংশীদার হলেও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ষাটের দশকে।

মার্কিন সেনাদের ব্যাপক প্রাণহানি ও অর্থনীতির ওপর চাপের কারণে সত্তরের দশকের শুরুতেই মার্কিন জনগণের মধ্যে এই যুদ্ধ বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ প্রবল হয়ে ওঠে। মনোবল ভেঙে যেতে থাকে মার্কিন সেনাদের। সব মিলিয়ে ভিয়েতনাম থেকে পিছিয়ে আসাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একমাত্র উপায়।

হেনরি কিসিঞ্জার সেই কাজটাই করিয়েছিলেন। তবে তার এই প্রচেষ্টার কারণে ভিয়েতনামে শান্তি আসেনি। অশান্তির যবনিকা ঘটে ১৯৭৫ সালে, যখন উত্তর ভিয়েতনামের বাহিনী দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সাইগন দখল করে নেয়।

প্রকাশ্যে আসা দলিলের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানায়, প্যারিস শান্তি চুক্তির দুই দিন পর ১৯৭৩ সালের ২৯ জানুয়ারি নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য হেনরি কিসিঞ্জার ও লে ডাক থো এর নাম প্রস্তাব করা হয়। প্যারিস চুক্তির মূল বিষয় ছিল, ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা।

এই চুক্তির কারণে শান্তি ফিরবে না বলে দাবি করে নোবেল পুরস্কার নিতে অস্বীকৃতি জানান লে ডাক থো। তিনি এটাও জানিয়েছিলেন, ভিয়েতনামে অস্ত্রের ঝঙ্কার কমলে এবং সত্যিকার অর্থেই প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়িত হয়ে শান্তি নেমে এলে তিনি পুরস্কার নেওয়ার কথা বিবেচনা করবেন।

১৯৯০ সালে ৭৮ বছর বয়সে মারা যান থো। এদিকে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হওয়ার পর সমালোচনার মুখে পড়েন কিসিঞ্জার। তিনি নিজে পুরস্কার নিতে যাননি, পুরস্কারটি তার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

তবে পরে তিনি আবার সেটা ফেরতও পাঠাতে চেয়েছিলেন, যদিও তখন নোবেল কমিটি আর তা ফেরত নিতে চায়নি। ভিয়েতনামের বিবদমান পক্ষগুলো প্যারিস চুক্তিকে গ্রহণ করেনি। কারণ, চুক্তির কোথাও দক্ষিণ ভিয়েতনামের সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টির উল্লেখ ছিল না।

প্রকারান্তরে দেশটির কোনো পক্ষই চুক্তিতে সম্মত হয়নি। বরং যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে যায়। উত্তরের বাহিনীগুলো দক্ষিণের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ও সহায়তা হারিয়ে দক্ষিণ এক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল উত্তরের যোদ্ধারা দক্ষিণের রাজধানী দখল করে নেয়।

যুদ্ধে পরাজিত স্থানীয় নেতারা ও রয়ে যাওয়া মার্কিন সেনারা দ্রুত পলায়ন করে। অবশেষে লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটে। নোবেল পুরস্কারের জন্য অনেক নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে কিসিঞ্জার ও থো এর নাম নির্বাচন করেন নোবেল পিস কমিটির সদস্য ও নরওয়ের শিক্ষাবিদ জন সানেস।

নোবেল কমিটিকে পাঠানো টাইপ করা চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‍‍`উত্তর ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র সংঘাতের ইতি টানার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে আলোচনা থেকে বের হয়ে আসা একটি চুক্তির মাধ্যমে। তবে আমি এটাও জানি, এই যুক্তির ফলাফল কী হবে তা কেবল ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডই বলতে পারবে।‍‍`

নোবেল কমিটির দলিল বিশ্লেষণ করে অসলো এর পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক স্টেইন টোয়েনেসন বলেন, ‍‍`নোবেল কমিটি স্পষ্ট করেই জানতো প্যারিস চুক্তি শান্তি আনতে পারবে না। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনার জন্যই কিসিঞ্জারকে মনোনীত করা হয়েছিল, ভিয়েতনামে শান্তি আনার জন্য নয়।

আর থোকে বাছাই করা হয়েছিল কারণ, নোবেল কমিটি কিসিঞ্জারকে এককভাবে পুরস্কার দেওয়াটা সমীচীন মনে করেনি। নোবেল কমিটি কিভাবে এরকম বাজে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেটা দেখে আমি বিস্মিত।‍‍`

আর্কাইভ