তাহজীবুল আনাম, কক্সবাজার প্রতিনিধি
এক মাস আগেও লাখো পর্যটকের পদচারণায় মুখর ছিল কক্সবাজার সৈকত। অথচ বর্তমানে সেখানে নেই একজন পর্যটকও। করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় চলছে পর্যটনের নিষেধাজ্ঞা। যার ফলে ফাঁকা পড়ে আছে সৈকত এলাকার পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস ও কটেজ। বন্ধ হয়ে আছে ৩০০ রেস্তোরাঁ, তিন হাজারেরও বেশি দোকানপাট। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন পর্যটন ব্যবসা সংশ্লিষ্ট তিন লাখ মানুষ।
অনেকেই আগের বছরের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে নতুনভাবে পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগ করেছিলেন। এসব বিনিয়োগকারীরা বর্তমানে চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন।
মাছ ও মাংস ব্যবসায়ী আবুল হাসান রুমী সিটি নিউজকে বলেন, ‘এরই মধ্যে পর্যটন এলাকার বিভিন্ন হোটেল-মোটেল ও রেস্টুরেন্টে প্রায় ৬০ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। তিন মাস আগে নতুনভাবে আরো বিনিয়োগ করেছিলাম। এখন ব্যবসা শুরু হলে আবার বিনিয়োগ করতে হবে। এত টাকা আমরা পাব কোথায়?’
সৈকতের ঝিনুক ব্যবসায়ী মহিন কবির বলেন, ‘পর্যটক থাকলে ঝিনুকের মালা বিক্রি করে প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা রোজগার করতে পারি। এখন মৌসুম থাকলেও পর্যটক আসা-যাওয়া বন্ধ হওয়ায় আমাদের ব্যবসা একেবারে বন্ধ। এখন অন্য কোনো কাজও করতে পারছি না। পরিবার নিয়ে খুব অভাব-অনটনে দিন কাটছে।’
সৈকতের ডাব ব্যবসায়ী শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘পর্যটক নেই তাই আমাদের ব্যবসাও বন্ধ। অভাবে কাটছে দিন। ডাব বিক্রি করে প্রতিদিন এক থেকে দুই হাজার টাকা আয় করতে পারি। এখন লকডাউনের কারণে সব বন্ধ। পরিবারের সাত সদস্য নিয়ে কষ্টে যাচ্ছে দিন। এদিকে সরকারের কাছ থেকে কোনো সাহায্য সহযোগিতাও পাচ্ছি না আমরা।’
হোটেল সী কুইন-এর মালিক মোশাররফ হোসেন খোকন বলেন, ‘গার্মেন্টস শিল্প কারখানা বাঁচিয়ে রাখতে সরকার সেসব প্রতিষ্ঠান চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তেমনি পর্যটন শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যটন স্পট খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। না হলে এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।’
হোটেল ক্যাসেল বেস্ট-এর জেনারেল ম্যানেজার আওলাদ হোসেন সিটি নিউজকে বলেন, ‘হোটেল-মালিক ও কর্মচারীরা বর্তমানে মানবেতর জীবন যাপন করছে। সেদিকে সরকারের নজর দেয়া প্রয়োজন। কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে পর্যটন শিল্প উন্মুক্ত করা যায়।’
হোটেল সাইমন ব্লু পার্ল-এর তত্ত্বাবধায়ক সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘পর্যটন শিল্প খুলে দেয়া না হলে অসংখ্য ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে যাবে। ব্যবসায়ীরা কয়েক দফা বিনিয়োগ করে পুনরায় ব্যবসা শুরু করেছিলেন। হঠাৎ কঠোর লকডাউন ঘোষণা করায় সবাই হতাশ হয়েছেন। সরকার নির্দেশিত স্বাস্থবিধি কঠোরভাবে মেনে চলার শর্তে পর্যটন শিল্প খুলে দেয়া প্রয়োজন। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসংখ্য পরিবারের ভাগ্য।’
হোটেল-মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার বলেন, ‘আমরা যারা বিনিয়োগকারী ছিলাম, আমরা আবার ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছি। এই পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তারা সরকারি কোনো প্রণোদনা পেয়েছে কি না আমার জানা নেই। তাই এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা অজানা শঙ্কায় রয়েছে। এ শঙ্কা কাটাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যটন স্পট খুলে দেয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্টহাউস অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক করিম উল্লাহ বলেন, ‘সৈকত এলাকার পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস, কটেজ, ৩০০ রেস্তোরাঁ, তিন হাজারের বেশি দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছেন পর্যটন ব্যবসা সংশ্লিষ্ট তিন লাখ মানুষ। ’
তিনি বলেন, ‘এদিকে সৈকতে পর্যটক না থাকায় অন্তত ৩০ হাজার কর্মজীবী ইতোমধ্যে চাকরি হারিয়েছেন। তাদের বেতনভাতা ও ঈদের বোনাস দিচ্ছে না মালিকপক্ষ। রোজার এই সময়ে তারা অনাহারে-অর্ধাহারে অমানবিক জীবন কাটাচ্ছেন। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে তারা এ পর্যন্ত কিছুই পাননি। গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত টানা পাঁচ মাস সৈকতে পর্যটকের সমাগম নিষিদ্ধ ছিল। এ সময় শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁও বন্ধ ছিল।’
গত ১ এপ্রিল মধ্যরাত থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত পর্যটন স্পটগুলো বন্ধ ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন। এর পর ৫ এপ্রিল থেকে শুরু হয় দেশব্যাপী সাত দিনের ‘কঠোর বিধিনিষেধ’। যা শেষ হওয়ার আগেই আরও দুই দফা বাড়িয়ে ‘কঠোর বিধিনিষেধ’র মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে আগামী ৫ মে পর্যন্ত।
ডব্লিউএস/এম. জামান/
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন