প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৬, ২০২২, ০৭:৪১ এএম
আজ ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস৷ বাঙালির শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার দিন৷ মুক্তিযুদ্ধ জয়ের আনন্দে উদ্বেলিত হওয়ার দিন। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের এই দিনেই বাঙালি জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিল।
ঢাকায় দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে এই দিনেই স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যালোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
আনন্দ উৎসব এবং শোক ও শ্রদ্ধার এক অপূর্ব সম্মিলনে দেশজুড়ে আজ উদযাপিত হবে ৫২তম বিজয় দিবস। মুক্তিযুদ্ধে সুমহান বিজয়ের ৫১তম বার্ষিকী।
একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতার স্পৃহায় জেগে ওঠা বাঙালিকে স্তব্ধ করতে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যায় মেতে ওঠে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ২৫ মার্চ কালরাতে।
সেই গণহত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষের ভাগ্যাকাশে নেমে এসেছিল ঘোর অমানিশা। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অবশেষে এগিয়ে আসে বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নেতৃত্বে আত্মসমর্পণ করে ৯১ হাজার ৫৪৯ জন হানাদার সেনা। বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে মুজিবনগর সরকারের পক্ষে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের উপস্থিতিতে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জ্যাকবের তৈরি করা আত্মসমর্পণ দলিলে সই করেন পাকিস্তানের পক্ষে লে. জেনারেল নিয়াজি এবং মিত্রবাহিনীর পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। আর অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তেই বিশ্ববাসীকে অবাক করে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাঙালি জাতি পায় লাল-সবুজের একটি জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত এবং মানচিত্র। রক্তাক্ত পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধের এই বিজয় অর্জন ছিল ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি।
বাঙালির এই স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় অর্জনের ইতিহাস শুধু ১৯৭১ সালেই সীমাবদ্ধ নয়। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের এক বছরের মধ্যেই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী আঘাত করে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ওপর। শুরু হয়ে যায় শোষণ-বঞ্চনা আর বৈষম্যের করুণ ইতিহাস। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সেই শোষণ থেকে মুক্তি পেতে বিক্ষুব্ধ বাঙালির জাতীয় চেতনার প্রথম স্ফুরণ ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। এই চেতনার ধারাবাহিক সংগ্রামের অংশ হিসেবে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা তথা স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, ১৯৬৯-এ গণতন্ত্র ও জাতীয় অধিকারের জন্য গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০-এ নির্বাচনী বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষার বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু গণতান্ত্রিক সে বিজয় পাকিস্তানি সামরিক শাসকচক্র মানতে পারেনি। ফলে অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসে ৭ মার্চ।
১৯৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালি জাতির পিতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হয় স্বাধীনতার অমোঘ বাণী- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মূলত সেদিন থেকেই গোটা জাতির মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর মধ্যরাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন দেশের স্বাধীনতা। ধানমন্ডির বাসভবন থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের আগমুহূর্তে বঙ্গবন্ধু তার স্বাধীনতার ঘোষণায় শত্রু সেনাদের বিতাড়িত করতে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে দেশবাসীকে অনুরোধ ও নির্দেশ দেন।
শুরু হয় হানাদারদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার চূড়ান্ত প্রতিরোধ লড়াই- মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাস ধরে চলা সেই মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ আর লুটতরাজের কলঙ্কিত অধ্যায়ের বিপরীতে রচিত হয়েছিল ইতিহাসের আরেকটি মহান অধ্যায়। সেই অধ্যায়ে ছিল মুক্তিকামী বাঙালির অসম সামরিক শক্তি ও দৃঢ় মনোবলের মধ্য দিয়ে যুদ্ধজয়ের বীরত্বগাথা। ১৭ এপ্রিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী সরকার। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয় ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে হানাদার বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। জন্ম নেয় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’।
আজ বিজয়োল্লাসে ভাসবে দেশ। আনন্দে উদ্বেলিত হবে গোটা জাতি। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত উদযাপিত হবে বিজয়ের দিনটি। উৎসবের সমারোহে জাতি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতাসহ মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদকে।
এ দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তারা দেশবাসীকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন অগণিত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদের আত্মত্যাগের কথা, যাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন সম্ভব হয়েছিল। পৃথক বিবৃতি দিয়েছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন।
দিনব্যাপী কর্মসূচি :বিজয় দিবস উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটি। সকালে ঢাকার তেজগাঁও পুরোনো বিমানবন্দর এলাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসের অনুষ্ঠানমালার সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপ জাতীয় পতাকা ও বিভিন্ন পতাকায় সাজিয়ে তোলা হবে। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিভিন্ন বাহিনীর বাদকদল বাদ্য বাজাবে।
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। পরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধারা শ্রদ্ধা জানাবেন।
এর পর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বিদেশি কূটনীতিক, স্বাধীনতা যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় সেনাবাহিনীর আমন্ত্রিত সদস্যরা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।
সকাল সাড়ে ১০টায় তেজগাঁও পুরোনো বিমানবন্দরের জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিএনসিসি, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, পুলিশ, র্যাব, আনসার ও ভিডিপি, কোস্টগার্ড, কারারক্ষী, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সমন্বয়ে গঠিত বাহিনীর বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রপতি এতে সালাম গ্রহণ ও কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করবেন। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। এ সময় বিমানবাহিনীর ফ্লাইপাস্ট, উড়ন্ত হেলিকপ্টার থেকে রজ্জু বেয়ে অবতরণ, প্যারাস্যুট জাম্প ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কিত যান্ত্রিক বহর প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে।
দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র ও নিবন্ধ প্রকাশ করবে। সরকারি-বেসরকারি বেতার ও টিভি চ্যানেলে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচারিত হবে। মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ অন্যান্য উপাসনালয়ে দেশ ও জাতির শান্তি-সমৃদ্ধি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা করা হবে। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন, রচনা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করবে।
বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতীয় পর্যায় এবং জেলা-উপজেলায় `জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ ও ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার` শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া মহানগর, জেলা ও উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হবে। ডাক বিভাগ স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করবে।
দিনভর নানা কর্মসূচি:
আওয়ামী লীগ তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এতে আছে- আজ প্রতুষ্যে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও সারাদেশের কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, ভোর সাড়ে ৬টায় সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে ও সাড়ে ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, ১১টায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার কবরে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলের পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, কবর জিয়ারত, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল; ১৭ ডিসেম্বর বেলা আড়াইটায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ‘শিখা চিরন্তন’ -এর সামনে থেকে ধানমন্ডি ‘বঙ্গবন্ধু ভবন’ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের বিজয় র্যালি;একইভাবে সারাদেশে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির আলোকে বিজয় র্যালি করা হবে।
বিএনপি আজ ভোরে দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করবে। সকাল ৯টায় সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, সকাল ১০টায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও মোনাজাত এবং বেলা আড়াইটায় নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে বিজয় র্যালি করবে দলটি। এ ছাড়াও সারাদেশে বিভিন্ন সংগঠন স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, আলোচনা সভা ও শোভাযাত্রা করবে।
এসএ/এএল