• ঢাকা বৃহস্পতিবার
    ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৪ পৌষ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে নারী

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৫, ২০২২, ০৯:৩৫ পিএম

মুক্তিযুদ্ধে নারী

মু আ কুদ্দুস

বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। পৃথিবীর যত মহৎ কাজ আছে তার প্রতিটি কাজে নারীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। পুরুষের সঙ্গে থেকে তারা সাহস এবং প্রেরণা দিয়েছেন।
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধেও তেমনি নারীদের অবদান অবিস্মরণীয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরুষদের সঙ্গে নারীরা যুদ্ধ করেছেন। পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন। 


স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নারীরা কাজ করেছেন সেবক হিসেবে। তারা মুক্তিযুদ্ধে অত্যাধুনিক অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ থেকে শুরু করে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।

যুদ্ধে  নারীরা বড় সহায়ক শক্তি ছিল, এ কথা বলতেই হবে। পাকিস্তানিদের দীর্ঘদিনের শোষণ ও পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশমাতৃকাকে উদ্ধার করার জন্য এ দেশের নারীরা পুরুষের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এই যুদ্ধে যেমন নারীদের উপস্থিতি ছিল তেমনি শিশুদের একটা বিরাট অংশ যুদ্ধে বিভিন্নভাবে কাজ করেছে। চিঠিপত্র আদান-প্রদান, গুরুত্বপূর্ণ খবর পৌঁছে দেয়া, যোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ এমন কাজগুলো তারা করেছেন।


নারীদের কেউ সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে আবার কেউ আড়ালে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। দুঃসাহসী নারীরা যে যেভাবে পেরেছেন, কাজ করেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছেন, প্রেরণা জুগিয়েছেন, সেবা করেছেন, অনাহারী-অর্ধাহারী ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কখনো মমতাময়ী মায়ের মতো, কখনো বোনের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে খাবার রান্না করে পাঠিয়েছেন। মুক্তি যোদ্ধাদের বাঁচানোর জন্য তাদের ঘরে নয়তো বাঙ্কারে রেখে বাইরে পাহাড়া দিয়েছেন। এ ছাড়াও যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে রক্ষা করতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরের খাবার তুলে দিয়েছেন। তারা ক্যাম্পে ক্যাম্পে কাজ করেছেন।

নারী মুক্তিযোদ্ধা

নারীরা শত্রুদের বিষয়ে, খানসেনা ও রাজাকারদের অবস্থান জেনে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর পৌঁছে দিতেন। বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা, অস্ত্র এগিয়ে দেয়া অথবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা ও চিকিৎসা সেবা করা, তাদের জন্য ওষুধ, খাবার ও কাপড় সংগ্রহ করাই ছিল নারীদের প্রধান কাজ।

নারী যোদ্ধারা পরিবার, স্বজন সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধের মতো কঠিন দায়িত্ব পালন করেছেন। একটি বাধাগ্রস্ত হলে যুদ্ধে জয়লাভ করা কঠিন হয়ে পড়ত, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

কাজেই নারীদের অবদান সমান গৌরবের। মুক্তিযুদ্ধে যারা অসামান্য অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে প্রশিক্ষণ সেবার দায়িত্বে নিয়োজিত কানন দেবী, উপাসনা রায়, সুধারানী কর, পূর্ণিমা রানী দাস ও নিপা রানী মুজমদারের নাম উল্লেখযোগ্য।

প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রীতি রানী দাস পুরকায়স্থ, শুক্লা রানী দে, হেমলতা দেব ছাড়াও আরও অনেকে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। ছায়ানট সভাপতি সনজীদা খাতুন কলকাতায় বসে মুক্তিদ্ধের রণাঙ্গনে গানের টিম পাঠিয়ে উজ্জীবিত করতেন যোদ্ধাদের। অপর দিকে,
নাজিয়া ওসমান চৌধুরী, সেলিনা বানু যোদ্ধাদের পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে অংশ নিয়েছেন অনেক নারীশিল্পী। যুদ্ধ চলাকালে অনেক নারী কবি, লেখক, সাংবাদিক যোদ্ধাদের পাশে থেকে প্রেরণা জুগিয়েছেন। তারা গান লিখেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস দেবার জন্য। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পুরুষদের সঙ্গে নারী শিল্পীরাও সঙ্গীত পরিবেশন করে অর্থ উপার্জন করে মুক্তি যোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করতেন। ওই সময় আব্দুল জব্বার, রথীন্দ্রনাথ রায়, আপেল মাহমুদ, আলী যাকেরসহ আরও অনেকে।

শাহনাজ বেগমের কণ্ঠে ‘সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা’, কল্যাণী ঘোষের ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’- এ রকম অজস্র গানের সুর শুনে মানুষ শিহরিত হয়েছে আর ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেশরক্ষার সংগ্রামে। পুরুষের পাশাপাশি নারীর বুদ্ধি-বিচক্ষণতা, আন্তরিকতা ও সাহসের ফল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। যুদ্ধের সময় অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন অনেক বাঙালি নারী।

তাদের মধ্যে কাঁকন বিবি, তারামন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, রওশন আরা প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এসব নারী সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গোবরা, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে। গোবরা ক্যাম্পে মেয়েদের দেয়া হতো তিন রকম ট্রেনিং। যেমন, সিভিল ডিফেন্স, নার্সিং, অস্ত্র চালনা ও গেরিলা আক্রমণ। ভারতে শরণার্থী শিবিরে ডাক্তার, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অনেক নারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সেবা করেছেন।

অপরদিকে, দেশের ভিতরে যে মায়েরা ছিলেন তারা সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছেন। তারা জানতেন, যুদ্ধের মাঠ থেকে না ফেরার সম্ভাবনা রয়েছে তা জেনেও স্ত্রী, মা, ভগিনী, কন্যারা প্রাণপ্রিয় স্বামী, পুত্র, ভাই ও বাবাকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন। তারা কেঁদেছেন এবং যুদ্ধ করতে প্রেরণা দিয়েছেন। 
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বহু মা-বোনকে সতীত্ব হারাতে হয়েছে। অনেকেই প্রাণ দিয়েছেন। তাদের সেই ত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

শেষে বলছি, নজরুলের কবিতার দুটি লাইন দিয়ে- নর বাহে হাল, নারী বহে জল, সেই মাটি মিশে-ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে।
 

 

সজিব/

আর্কাইভ