প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৪, ২০২২, ১২:৪৫ এএম
কুষ্টিয়ার মিরপুর থানা সদরের মিরপুর গ্রামে আমাদের বাড়ি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার বয়স ৯ পেরিয়ে ১০ এ পড়েছে। পড়ি ক্লাস থ্রি তে। স্কুল থেকে ফেরার পর খেলাই ছিল আমার প্রধান কাজ। দিনভর খেলা ছুটাছুটি আর দৌড়াদৌড়িতেই কাটতো সময়। জানতে পারলাম আমাদের গ্রামের আতিয়ার ভাই আমার চেয়ে বছর ছয়েকের বড়। তিনি একটি বড় নৌকা বানিয়েছেন। ছুটলাম সেই নৌকা দেখতে।
তিনি বাঁশ ও কাঠ দিয়ে ৫/৬ ফুট লম্বা নৌকা বানিয়েছেন। ওই নৌকার উপর সিমেন্টের কাগজ দিয়ে একখান ছৈও বসিয়েছেন। নীচে বাবলা কাঠের ডাল দিয়ে ধুরো লাগিয়ে তাতে চারটি চাকাও লগিয়েছেন। চাকা চাকা গুলোও বাবলা কাঠের তৈরী। নৌকাটি দেখতে বেশ সুন্দর হয়েছে।
এই নৌকাটি সে কেন বানিয়েছে, কিজন্য বানিয়েছে, তা জানিনা। তবে তার বানানো নৌকাখানি আমার খুবই পছন্দ। সকাল হলেই চলে আসতাম তার বাড়ি। কখনও বিকেল কখনো সন্ধ্যাবধি ওই নৌকার আকর্ষনেই বসে থাকতাম। শিশু মন বারবার ওই নৌকাখানি নিয়ে টানাটানি খেলার সাধ করেছে। কিন্ত আতিয়ার ভাই সে সাধ মেটাতে দেননি। তবে একেবারে নিরাশও করেননি। উনি বলতেন সন্ধ্যায় মিছিল বেরোবে তখন আসিস। তোকে নৌকা টানতে দেব।
তর সয়নি। সন্ধ্যার আগেই এসে নৌকার দড়ি ধরে বসে থ্কলাম। তারপর সেটাকে টেনে সদর রাস্তা পর্যন্ত আনার সুযোগ পেতাম। ওই নৌকাকে ঘিরে জড়ো হতো লোকজন। এরপর জয় বাংলা বলেই শুরু হতো মিছিল। সেই মিছিলের অগ্রভাগে নৌাকার দড়ি ধরে টেনে নিয়ে যেতেন আতিয়ার ভাই। মিছিলটি বাজার হয়ে একেক দিন একেক গ্রামে যেত। যাওয়া পর্যন্ত আতিয়ার ভাই ড্রাইভার আর আমি হেলপার থাকতাম। ফেরার সময় লোকজন তেমন একটা থাকতো না। তখন আতিয়ার ভাই নৌকার দড়ি আমার হাতে দিয়ে দিতেন। আমি নৌকা টেনে তার বাড়ি অবদি পৌঁছে দিতাম। এই কাহিনী এই পর্যন্তই মনে আছে। বড় হয়ে জেনেছি সেময়টি ছিল ৬৯ এর গণভোট।
এর কিছুদিন পর দেখলাম আশে পাশের বিভ্ন্নি গ্রাম থেকে হাজার হাজার লোক এসে ব্রিকফিল্ডে (মিরপুর বাস স্ট্যান্ড এলাকাকে তখন ব্রিকফিল্ড নামে উল্লেখ করা হতো) জড়ো হচ্ছেন। তাদের হাতে ঢোল সড়কি লাঠি বল্লম বাটুল ইত্যাদি। তারা কেন জড়ো হচ্ছে কিজন্য জড়ো হচ্ছে সে জ্ঞান আমার ছিলনা। তবে শুনলাম মিলিটারিরা কুষ্টিয়াতে এসেছে। তাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য লোকজন জড়ো হচ্ছে।
পরের দিন সকালে এসে দেখলাম ওই এলাকার অদুরেই মাঠের ভিতরে ফৈজদ্দি মালিথার আমবাগানে লাইনে দাঁড়িয়েছেন অনেক লোক। শুনলাম মিলিটারীদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য আনসারে লোক নিচ্ছে। গেলাম সেখানে। দেখলাম আমাদের গ্রামের আব্দার চাচা সব লোকদের দাঁড় করিয়ে মাথার মাপ নিয়ে কাগজে কি যেন সব লিখছেন। ছিলেন হয়তো আরো অনেকেই। তবে এর মধ্যে আমি কেবল আব্দার চাচাকেই চিনি। তাই তার কথাই আমার মনে আছে। আরো মনে আছে এই জন্য যে, মাথায় ছোট হওয়ায় আব্দার চাচা আমাকে লাইন থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
পরের দিন দেখলাম আশে পাশের গ্রাম থেকে আবারো হাজার হাজার লোকজন ঢাল সড়কি লাঠি ফালা নিয়ে মোড়ে সমবেত হয়েছেন। এর মধ্যে ফুলবাড়িয়ার আবজাল চাচা কাঁধে একটি রেডিও ঝুলিয়ে সাইকেলে উঠে লোকজনদের কি যেন বলছেন। কাছে গিয়ে শুনলাম, তিনি বলছেন, মিলিটারিরা কুষ্টিয়ার টাউনে লোকজনদের মেরে ফেলছে। লোকজন ভিড় করে তার বক্তব্য শুনছে। শুনার কারনও আছে। চাচা সব সময় কাঁধে একটি রেডিও ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। রেডিওর খবর শুনে লোকজনদের বলে বেড়ানো ছিল তার অভ্যাস।
শুনলাম মিলিটারিরা নাকি আমাদের এলাকায় আসার জন্য রওয়ানা দিয়েছে। গাছ কেটে ররাস্তা বন্ধ করার কথা হলো। এর সঙ্গেসঙ্গে আমাদের প্রতিবেশি দুলাল কাজী চাচা কুড়াল এনে হারেজ মোল্লার বাড়ির সামনের বড় শিমুল গাছে কোপ দেওয়া শুরু করলো। সেখানেও আমি ছিলাম। কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধে তিনি মারা গেছেন। ওই গাছ এখনো তার কুড়ালের চিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছে।
গাছ কাটা শেষ না হতেই দেখলাম মিলিটারির একটি জিপ এসে গাছের কাছে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে অস্ত্রধারী মিলিটারিদের নামতে দেখেই যে যেদিকে পারলো ছুটে পালালো। দুলাল চাচাও কুড়াল ফেলে পালিয়ে গেল। তারা নেমে স্থানীয়দের বললো আমরা পাক মিলিটারি নয় ইপিআর (তখন বর্ডার গার্ডের নাম ছিল ইপিআর (ইস্টপাকিস্থান রাইফেলস)। আমরা পাক মিলিটারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য চুয়াডাঙ্গা থেকে এসেছি। তাদের পেছনে বড়বড় ট্রাকে এলো আরো ইপিআর সোলজারর্স। তারা স্থানীয়দের সাথে কথা বলে মোড়ের মাদ্রাসার ভেতরে ক্যাম্প করলো। এলাকার লোকজন ভিড় করে তাদের দেখতে লাগলো। কারন তখন পুলিশ ও আনসারের বাইরে সুসজ্জিত কোন সেনাদল কাছ থেকে দেখার সুযোগ পায়নি এলাকার মানুষ।
পড়ন্ত বিকেলে ওই ক্যাম্পের সামনে দিয়ে আমার চাচাতো ভাই মহাম্মদ উল্লাহ ওরফে বুধু মিলিটারি যাচ্ছিলেন। তার পরিচয় পেয়ে ইপিআররা তাকে দলে সংযুক্ত করে নেয়। ৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর অবসরে আসা বুধো ভাই আবার পোশাক পরে যুদ্ধে গেলেন। ভাই কখন যুদ্ধে গেছেন তা আমি দেখিনি। সকালে এসে দেখলাম এলাকার লোকজন বিভিন্ন গাছ থেকে ডাব পেড়ে নিয়ে যাচ্ছেন নওয়াপাড়া বাজারে অবস্থিত মুক্তি যুদ্ধের সংগঠক সুফি ভাইয়ের বাড়িতে। আমিও ডাব ও রুটির রশদ সংগ্রহ করে বন্ধুদের নিয়ে গেলাম সুফি ভাইয়ের বাড়িতে। দেখলাম ডাবের স্তূপ আকাশ ছোঁয়া। রটির খামালও তার চেয়ে কম নয়। এসব খাদ্য যাচ্ছে কুষ্টিয়ায়। সেখানে মিলিটারিদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করছে এসব তাদেরই জন্য। সঙ্গি জগলুল হায়দারকে সাথে নিয়ে পকেটের গুলতিকে হাতিয়ার মেনে আমরা দুজনও কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। বলিদাপাড়া ব্রিজ পর্যন্ত যাওয়ার পরই আমাদের আটকে দিল পথের লোকজন। তারা বললো শহরে যুদ্ধ চলছে। তোমরা বাড়ি যাও। কি আর করা দুজনে ফিরে এলাম।
পড়ন্ত বিকেলে খবর এলা দুলাল কাজী চাচা যুদ্ধে মারা গেছেন। তার বাড়িতে উঠলো কান্নার রোল। সন্ধ্যার আগ দিয়ে আমাদের বুধো মিলিটারী ভাই একটি সাদা গাড়িতে করে দুলাল চাচার লাশ তার বাড়িতে পৌঁছে দিলেন। দুলাল চাচার গলায় গুলি লেগে বেরিয়ে গেছে। তার গায়ে খাকি কাপড়ের মিলিটারি পোশাক ছিল। ওই পোষাকেই তাকে সমাহিত করা হলো। শুনলাম যারা শহীদ হয় তাদের নাকি কাফন দেওয়া হয়না। যে পোশাকে থাকে সেই পোশাকেই তাদের দাফন করা হয়।
আগামী সংখ্যায় বলবো কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধে হেরে যাওয়া পাক আর্মিদের কিভাবে পিটিয়ে মারা হয়েছিল। (চলবে)