প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩, ২০২২, ০৪:৪৩ এএম
পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের স্বাধীনতা চুক্তি বা সন্ধির ফসল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা তার একটিও নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের ফসল। খুব কম জাতিই এই ফসল অর্জন করতে পেরেছে। রাশিয়ার চেঁচেনরা আজও স্বাধীনতা যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এলটিটিই যুদ্ধ করতে গিয়ে নি:শেষ হয়ে গেছে। রোহিঙ্গারা ভিটেমাটি হারিয়েছে। আরও অনেক জাতি স্বাধীনতার জন্য লড়ে যাচ্ছে। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় চূড়ান্ত হয়েছিল।
ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। এই বিজয় আমাদের স্বাধীনতা। এই বিজয় আমাদের গৌরব। এই স্বাধীনতা আমাদের অহংকার। এই অহংকার অর্জন করতে ৩০ লাখ বাঙালি আত্মহুতী দিয়েছে। অসংখ্য মা বোন ইজ্জত হারিয়েছেন। তবুও আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমরা বীর বাঙালি। আমরা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠজাতি। স্বাধীনতার মাসে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাদের, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে পেয়েছি স্বাধীনতা। বিজয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জানাই সালাম।
এই অর্জনের আমি প্রত্যক্ষ সৈনিক হতে পারিনি। তবে একজন শিশু মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকায় থেকে কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যোদ্ধাদের জন্য রশদ টেনেছি। ভাইয়ের কাঁধে উঠে নয় মাইল অতিক্রম করে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। প্রত্যক্ষভাবে শুনেছি তার ভাষণ।
সেই গৌরবকে হৃদয়ে লালন করে নতুন প্রজন্মের জন্য তুলে ধরছি শিশু মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি। যুদ্ধের সময় আমার বয়স ৯/১০ বছর। পড়ি তৃতীয় শ্রেণীতে। সকাল ৯টার সময় বাড়ির উঠানে পাটি পেতে শরীর দুলিয়ে পড়ছি। মা হেঁসেলে ভাত রান্না করছেন। আব্বা গেছেন মাঠ তদারকীতে। ভাইয়েরা যে যার কাজে গেছেন বাইরে। এমন সময় শুনতে পেলাম ঠা-ঠা-ঠা আওয়াজ। মা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে অনুমান করতে চাইলো যে, আওয়াজটা কিসের। কারণ এ আওয়াজ সেও কোনো দিন শোনেনি আমরাও জানিনে।
পাশের বাড়ির মরি খালা ও তার স্বামী চিৎকার চেঁচামেচি করে বলতে লাগলো বাজারে মিলিটারি এসেছে। বাজারে আগুন দিয়েছে। তারা গুলি করছে। এইটা মেশিন গানের গুলির শব্দ। যে যেদিকে পারো পালাও পালাও। বিপদের ভয়াবহতা অনুভব করে ছোট বোন নাজিরাকে নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। বই খাতা স্কুল ব্যাগে ভরে নিয়ে দুই ভাই বোন হাতধরাধরি করে ছুটতে লাগলাম। কোথায় যেতে হবে বা যাবো তা জানি না। গায়ের সব লোক যেদিকে দৌড়াচ্ছে আমরাও সেই দিকে ছুটতে লাগলাম।
কিছু লোক আরও নিরাপত্তার জন্য নয়নপুরের দিকে গেল। আমরা যাদের ফলো করে দৌড়াচ্ছিলাম তারা গ্রাম লাগোয়া বিলের মাঠের দিকে গেল। তারা সবাই আখ ক্ষেতের মধ্যে লুকালো। আমরাও তাদের সঙ্গে লুকিয়ে রইলাম। ঘণ্টা দুই তিনেক লুকিয়ে থাকার পর শুনলাম মিলিটারিরা কুষ্টিয়া শহরের দিকে চলে গেছে।
সব লোক কুশুরের (আখ ক্ষেত) মাঠে লুকানো অবস্থা থেকে বের হতে শুরু করলো। আমরাও তাদের সঙ্গে বাইরে বের হলাম। বাইরে এসে দেখি আমার আব্বা বড় ভাই মেঝো ভাই কেঁদে কেঁদে যাকে পাচ্ছে তাকেই জিজ্ঞাসা করছে আমাদের কথা। আমাদের দুই ভাই-বোনকে পেয়ে তারা যে কি বিজয় অর্জন করলো তা যেন তারাই জানে। তাদের সেই খুশির চেহারা আজও আমার মনে আছে।
বাড়ি ফিরতে দুপুর পেরিয়ে গেল। ভাত রান্না হয়নি। সকাল থেকে কারো খাওয়াও হয়নি। কি আর করা ঘরে চিড়া ছিল তাই খেয়েই সবার ক্ষুধা মিটলো। বিকেলের দিকে আবা সিদ্ধান্ত নিলেন যেহেতু আমাদের বাড়ি কুষ্টিয়া-মেহেরপুর সড়কের ধারে তাই বাড়িতে থাকা ঠিক হবে না।
এই বিবেচনায় আমাদের পুরো পরিবার জিকে ক্যানেলের ওপারে থাকা কুরিপোল গ্রামে চলে গেল। সেখানে আমার মেঝো ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি। আমরা সেখানেই থাকতাম। রাতে আব্বা একা আমাদের বাড়ি পাহারা দিতেন। তার সঙ্গে থাকতেন আমাদের প্রিয় পোষা কুকুর ভ্যাগোল। ৯ মাসের যুদ্ধ কালের মধ্যে প্রায় ৪/৫ মাস আমরা আত্মীয়দের বাড়িতে শরণার্থী হয়ে ছিলাম। (চলবে)
এবি/এএল