• ঢাকা রবিবার
    ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

অবাধ বিচরণই নয়, কারাগারে পার্টিও করে জঙ্গিরা

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৪, ২০২২, ১২:২৪ এএম

অবাধ বিচরণই নয়, কারাগারে পার্টিও করে জঙ্গিরা

ইমরান আলী, ঢাকা

রাজধানীর আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় আবারো আলোচনায় এসেছে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার।এ কারাগারে থাকা জঙ্গিদের পরিকল্পনায় ঘটেছে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা। আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাকিব ও শামিমকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। শুধু এ পরিকল্পনাই নয় কারাগারে থাকা জঙ্গিদের নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। পুরো কারাগার জুড়েই অবাধ বিচরণ করে জঙ্গিরা।  এছাড়া গতবছর আফগানিস্থানে তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেখানে ভূরিভোজ বা বিশেষ খানারও আয়োজন করেছিল তারা। মনে করা হচ্ছে, কারাগারের বাইরের চাইতে হাইসিকিউরিটি কারাগার তাদের জন্য হাইসিকিউর। সেখানে বসে হত্যা, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা পরিকল্পনা করেছে - করছে দূর্ধর্ষ এ সকল জঙ্গিরা।

কারাগার কর্তৃপক্ষ সবকিছু জেনেই নিরব দর্শকের ভূমিকায় থাকে। নিয়মিত তাদের নিকট থেকে মেলে মাসোহারাও। কাউন্টার টেরোরিজমের কর্মকর্তারা জঙ্গি ছিনতাইয়ের পর ওই কারাগারে থাকা কয়েক জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছেন। কারাগারের এসব দূর্বলতা সামনে আসায় মঙ্গলবার (২২ নভেম্বর) হাইসিকিউরিটি কারা কর্মকর্তাকে বদলিও করা হয়েছে।

তালেবানদের ক্ষমতা দখল ও কারাগারে ভূরিভোজ : আফগানিস্থান থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার পরপরই সক্রিয় হয়ে উঠা তালেবনারা। মাসখানেকের মধ্যে ২০২১ সালের ১৫ আগষ্ট আফগানিস্থানের পুরো ক্ষমতা তারা দখল করে নেয়। এ খবর গাজিপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে থাকা জঙ্গিরাও পায়। এর একদিন পর ১৬ আগষ্ট সেখানে ভূরিভোজ বা বিশেষ খানার আয়োজন করে জঙ্গিরা। এদিন তারা আনন্দ উল্লাসও করেছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। তাদের এ উল্লাসে যোগ দেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্য কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদি ও ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত মোবারক হোসেন। আর এ আয়োজন করে দূধর্ষ জঙ্গি বিল্লাল।  

সংশ্লিস্ট সূত্রে জানা যায়, জঙ্গি ছিনতাই ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে মিলে চাঞ্চল্যকর তথ্য। এমনকি কাউন্টার টেরোরিজমের কর্মকর্তারাও ছুটে যান কারাগারে। সেখানে থাকা জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদও করেন তারা। এ সময় ছিনতাইয়ের ঘটনায় কারাগারে থাকা জঙ্গিদের সম্পৃক্ততার তথ্যের প্রমানও পান।   

ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা কারাগারে : দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনার কথা আগেই জানানো হয় কারাগারে আটক শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান ও সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাবসহ চারজনকে। গত সপ্তাহের শুরুতে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে তাদের সঙ্গে দেখা করে এই পরিকল্পনার কথা জানান জঙ্গিদের দুই স্বজন। তাদের খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পাশাপাশি ঘটনার সময় তাদের কি করণীয় থাকবে তারও নির্দেশনা দেওয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী, রোববার (২০ নভেম্বর) দুপুরে আদালতে অপারেশন চলে। জঙ্গিদের লক্ষ্য ছিল চারজনকে ছিনিয়ে নেওয়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ইমরান ও সাকিবকে ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়। ওই সময় শাহিন আলম ওরফে কামাল ও শাহ আলম ওরফে সালাউদ্দিনকে ছিনিয়ে নিতে ব্যার্থ হয় তারা।

এদিকে সম্প্রতি হাইসিকিউরিটি কারাগার নিয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনও দেয় গোয়েন্দারা।

প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, কাশিমপুর কারাগার পার্ট-১ দূর্ধর্ষ জঙ্গি নেতা, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দণ্ডপ্রাপ্তসহ অনেক খুনি আসামিরা এ কারাগারে রয়েছেন। বিশেষ করে নব্য জেএমবির দূর্ধর্ষ বিল্লালও রয়েছে এ কারাগারেই। মূলত: বিল্লালের নেতৃত্বেই কারাগারে থাকা জঙ্গিরা একজোট। মাঝে মধ্যেই তারা একসঙ্গে মিটিং করে থাকে বলেও সূত্র জানায়। এছাড়াও বাইরে থেকে দর্শনার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত দেখাশোনা এমনকি বিভিন্ন নির্দেশনাও দিয়ে যাচ্ছে বলেও বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। ঝিমিয়ে পড়া জঙ্গিদের সক্রিয় করতে কারাগারে বসেই ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করছে এসব জঙ্গি নেতারা। বাইরে থাকা অনুসারীদের নানা নির্দেশনা দিচ্ছে। মোবাইলে বিভিন্ন সিক্রেট অ্যাপসের মাধ্যমে এসব নির্দেশনা পাঠানো হচ্ছে। কিছু অসাধু কারারক্ষীর মাধ্যমে মোবাইল ফোন ম্যানেজ করে জঙ্গি নেতারা।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ ও আনসার আল ইসলামের শীর্ষ চার নেতার মধ্যে কারাগারে যোগাযোগ হয়। এরা হলো-জেএমবির নাহিদ তাসনিম ও আবু সাঈদ, আনসার আল ইসলামের আল আমিন ও হরকাতুল জিহাদের ফয়সল। তিন সংগঠনের আদর্শ প্রায় একই ধরনের হওয়ায় তারা জেলে বসেই ভয়ঙ্কর মিশন বাস্তবায়নের অভিন্ন পরিকল্পনা করে আসছে। মোবাইলে ভার্চুয়াল মাধ্যমে কারাগারের বাইরে থাকা অনুসারীদের অর্থ সংগ্রহের নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। সেই নির্দেশনা অনুসারে তাদের সহযোগীরা পেশাদার ডাকাত দলের সঙ্গে মিশে শুরু করে ডাকাতি। এরপর ডাকাতির অর্থের একটি অংশ চলে যায় কারাবন্দি শীর্ষ জঙ্গি নেতাদের কাছে। কারাবন্দি নেতাদের নির্দেশনায় ডাকাতির টাকায় ‘হালাল ও ফ্রেশ’ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও কারাগারে গড়ে তোলে জঙ্গিরা। আর বাকি অংশ ব্যয় করা হয় সংগঠনের কথিত দাওয়াতি কাজে।

সুবিধা পাচ্ছে জঙ্গি নেতা ও ফাঁসির আসামি : কাশিমপুর পার্ট ১ এ নব্য জেএমবির প্রধান বিল্লালের সঙ্গে বিশেষ সখ্যতা রয়েছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির আসামি মোবারক হোসেনের। ফাঁসির আসামিরা বিশেষ সেলে থাকার কথা। কিন্তু মোবারক হোসেন ফাঁসির আসামি হওয়া সত্বেও পুরো কারাগার ঘুরে বেড়ান, তার সঙ্গে থাকে বিল্লাল। মূলত কারাগারে এই দু’জনই প্রভাবশালী। কারাগারের ভেতরে তারা ব্যবসাও করছেন। মোবারকের সহায়তায় বিল্লালের নেতৃত্বে সিগারেট ব্যবসা করছেন সেখানে। ভেতরে যত সিগারেট যায় এগুলো বিল্লালই দেখাশুনা করছে। এই কাজে দুই কারারক্ষী ইউসুফ ও হান্নান তাদের কাজে সহযোগীতা করছেন।এছাড়াও ক্যান্টিন নিয়ন্ত্রন, বিভিন্ন কয়েদি রাইটার নিয়োগও তারাই দিয়ে থাকে। এই খাত থেকে মাসে কয়েক লাখ টাকা আসে। আর এ টাকা কারাগারের বাইরে থাকা বিভিন্ন জঙ্গিদের হাতে যায়। এছাড়াও যে সকল জঙ্গি কারাগারে রয়েছে তাদের পরিবারের নিকটও যায় অর্থের একটি অংশ।

করোনাকালীন সময়ে কারাগারে বন্দিদের দেখা নিষিদ্ধ থাকলেও এর কোন নিয়মই মানা হয়নি।বিশেষ করে মোবারক ও বিল্লালের নিকট লোক আসলে তাদেরকে বিশেষ ব্যবস্থায় দেখা করানো হয়।

এদিকে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, আইনের দীর্ঘসূত্রতার কারণে জঙ্গিরা বছরের পর বছর কারাগারেই বন্দি থাকে। বিভিন্ন পন্থায় কারাগার থেকে তারা নিজ নিজ সংগঠনের সদস্যদের বার্তা পাঠায় এমন খবরই পাওয়া যাচ্ছে। ফলে বাইরের জঙ্গিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃঢ়তায় দুর্বল হয়ে পড়লেও কারাগারে থাকা জঙ্গিরা বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও সাক্ষী ও উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে জামিনে বের হয়ে কারাগারে থাকা শীর্ষ নেতাদের দেয়া নির্দেশ পালন করছে অনেকে। এই অপতৎপরতা দমনে দ্রুত বিচার কার্যকর করা, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের এ বিষয়ে আরো গুরুত্ব দেয়া এবং কারাগারে সংশোধনাগারের ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, কারাগারে যে ব্যবস্থায় জঙ্গিদের রাখা হয়, সেখানে তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নতুন জঙ্গি তৈরি হওয়া সম্ভব। যেহেতু জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনায় হাতেগোনা কয়েকজনই যথেষ্ট, সেহেতু কারাগারে বন্দি জঙ্গিরাই বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

সিটিটিসির প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার আসাদুজ্জামান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার বেশ কয়েকজন জঙ্গির কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে তারা কারাগারে থাকা শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে নির্দেশনা পেত। আবার অনেকে কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে নাশকতায় অংশও নিয়েছে। এটিকে আমরা বড় ধরনের হুমকি মনে করছি না। তবে কারাগারে থেকে যাতে কোনো জঙ্গি তথ্য আদানপ্রদান করতে না পারে, সেদিকে আমাদের নজরদারি রয়েছে।

সিনিয়র জেল সুপার বদলি :  সিনিয়র জেল সুপার মো. আব্দুল আজিজকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার এবং রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালাকে হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার হিসেবে বদলি করা হয়েছে। ধারনা করা হচ্ছে সাম্প্রতিক এ ঘটনায় অনেকটা তোপের মুখেই তাকে বদলি করা হয়।

আর্কাইভ