প্রকাশিত: নভেম্বর ২১, ২০২২, ১০:৩৭ পিএম
আবারো আলোচনায় এসেছেন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের আধ্যাত্মিত নেতা সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত মেজর জিয়া। রোববার ঢাকার আদালত থেকে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের দুই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিনিয়ে নেয়ার মাধ্যমে আবারো আলোচনায় আসেন তিনি। আনসারুল্লাহ বাংলাটিম যখনই কোন ঘটনা ঘটায় তখনই তিনি আলোচনায় আসেন। মূলত অপারেশনাল কমান্ডার হিসেবে মূল পরিকল্পনা করে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেন সংগঠনের স্লিপার সদস্যের ওপর। পুলিশ বিভিন্ন সময় তার খুব কাছাকাছি গেলেও গ্রেফতার করতে পারেনি। প্রায় ১০ বছর তিনি অধরা রয়েছেন। পুলিশ তাকে গ্রেফতারে গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছে।
সূত্র মতে, রোববার আদালতের ঘটনায়ও তাকে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে চিহ্নিত করেছে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তার পরিকল্পনাতেই ১০/১২ জন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সদস্যরা পুলিশের ওপর পিপার স্প্রে ব্যবহার করে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ছিনিয়ে নেয়া আসামিরা হলেন, সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার মাধবপুরের মইনুল হাসান শামীম এবং লালমনিরহাটের আদিতমারি উপজেলার ভেটেশ্বর গ্রামের আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব। এরা প্রকাশক দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।
ডিএমপির গোয়েন্দা প্রধান ডিআইজি হারুনুর রশিদ বলেছেন, জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় মাস্টারমাইন্ড জিয়া। মূলত কাট আউট পদ্ধতিতে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সদস্যরা এ কাজ করেছে। ছিনিয়ে নেয়া জঙ্গিসহ এর সাথে যারা জড়িত তাদের গ্রেফতারে কাজ করা হচ্ছে।
র্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, পলাতক জঙ্গিদের গ্রেফতারে কাজ করছে র্যাব। ইতিমধ্যে র্যাবের বেশ কয়েকটি টিম মাঠে কাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০১৩-২০১৫ সালে টার্গেট সিরিজ হত্যাকাণ্ড ঘটায় জঙ্গিরা। তাদের ধারালো চাপাতির আঘাতে নৃশংসভাবে খুন হন নয়জন ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, অধিকার নাট্যকর্মী। আট বছর আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় প্রথমে মিরপুরে হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্লগার রাজীব হায়দার।
পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে আমেরিকা প্রবাসী ব্লগার ও লেখক প্রকৌশলী ড. অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন, ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়, নাজিম উদ্দিন সামাদ, জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয়কে একই কায়দায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে উগ্রপন্থি জঙ্গিরা।
পুলিশি তদন্তে উঠে আসে, বর্বর এসব হত্যাকাণ্ড ঘটায় জঙ্গিগোষ্ঠী আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি)- যার মাস্টারমাইন্ড (মূল পরিকল্পনাকারী) শীর্ষ জঙ্গিনেতা বরখাস্তকৃত মেজর সৈয়দ মো. জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া। তার পরিকল্পনায় ও নির্দেশনায় স্লিপার সেলের দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা ওই সিরিজ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। কিন্তু গত ১০ বছর ধরে পলাতক জিয়া আদৌ কি গ্রেফতার হবেন-এমন প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে।
২০১২ সালে সেনাবাহিনীতে একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টার পরই আলোচনায় আসেন মেজর (চাকরিচ্যুত) জিয়া। অভ্যুত্থানচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর থেকেই সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার আর কোনো সন্ধান মেলেনি। জঙ্গি হামলার এ হোতাকে ধরিয়ে দিতে ২০১৬ সালে আগস্ট মাসে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ। জিয়াকে ধরতে বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করা হলেও আজও তিনি রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশক দীপন হত্যা মামলায় এই জঙ্গিনেতা জিয়াসহ আট আসামির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়কে হত্যার আলোচিত মামলার রায় ঘোষণা হচ্ছে আজ মঙ্গলবার।
চাঞ্চল্যকর এ মামলায়ও ৬ আসামির মধ্যে প্রধান জিয়া। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ধারাবাহিক অভিযানে জঙ্গিদের তৎপরতা এখন নিয়ন্ত্রণে। তবে এই হত্যাকাণ্ডগুলোর মূল পরিকল্পনাকারী চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত আতঙ্ক দূর হবে না বলে মনে করেন নিহতের পরিবারের সদস্য ও মুক্তমনারা।
সিরিজ ব্লগার-লেখক হত্যাকাণ্ড: ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৮টার দিকে বইমেলা থেকে বের হয়ে টিএসসির কাছে গেলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাংলাদেশি ব্লগার অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার ওপর হামলা চালানো হয়। ঘটনাস্থলেই নিহত হন অভিজিৎ। আহত হন বন্যা। এ ঘটনায় পরদিনই অজ্ঞাতপরিচয় হামলাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন অভিজিতের বাবা অধ্যাপক ড. অজয় রায়। ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় চাপাতিসহ তিন যুবক ওয়াশিকুর রহমান বাবুর ওপর হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করে। পরবর্তীতে বাবুর বোনের জামাই মনির হোসেন বাদী হয়ে তেজগাঁও থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
২০১৫ সালের ১২ মে সকালে সিলেট শহরের সুবিদবাজারে কাজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলে হত্যা করা হয় অনন্ত বিজয় দাশকে। পরবর্তীতে জঙ্গি সংগঠন এবিটি এই হত্যার দায় স্বীকার করে। ২০১৫ সালের ৭ আগস্ট রাজধানীর গোড়ানের ভাড়া বাসায় হত্যা করা হয় ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়কে।
২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল রাজধানীর পুরান ঢাকার হৃষিকেশ দাস লেনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী নাজিম উদ্দিন সামাদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগানে বাসায় ইউএসএইডের সাবেক কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব রাব্বি তনয়কে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ২০১৯ সালের ২৮ জুলাই জিয়াসহ আনসার আল ইসলামের আট সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে পুলিশ।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়ার নেতৃত্বে জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) পরিচালিত হয়। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম আনসার আল ইসলাম নামেও পরিচিত। জঙ্গিনেতা জিয়াই স্লিপার সেলের জঙ্গি খুনিদের মাধ্যমে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত কে এই জঙ্গিনেতা মেজর জিয়া: ২০১৩-২০১৫ সালের মধ্যে অন্তত ৯ জন লেখক ও ব্লগার হত্যার মাস্টারমাইন্ড বা মূল হোতা সাবেক সেনা কর্মকতা জিয়া। জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী প্রকাশক ও ব্লগার ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় তিনিসহ এবিটির ৮ জঙ্গির ফাঁসির আদেশ হয়েছে। তার পুরো নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক। তার বাবার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিল্লুল হক। তার গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুরে। ২০১২ সালে সর্বশেষ তিনি মিরপুর সেনানিবাসে থাকতেন।
২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি সেনাবাহিনী এক সংবাদ সম্মেলনে সরকার উৎখাতে ধর্মান্ধ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার একটি অভ্যুত্থান পরিকল্পনা নস্যাৎ করার খবর দেয়। তখনই প্রবাসী ব্যবসায়ী ইশরাক আহমেদ ও মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হকের নাম আসে- যারা ওই অভ্যুত্থান চেষ্টার মূল পরিকল্পনাকারী বলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়। পরবর্তীতে চাকরিচ্যুত হওয়ার পর থেকে পলাতক রয়েছেন তিনি।
গোয়েন্দা সূত্র মতে, দেশে ব্লগার, প্রকাশক, মুক্তমনা লেখকদের টার্গেট কিলিং করতে ২০১৩ সালে জিয়ার তত্ত্বাবধানে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা এবিটির অন্তত আটটি স্লিপার সেল হয়। প্রতিটি সেলের সদস্য সংখ্যা চার থেকে পাঁচজন ছিল। সেই হিসাবে অন্তত ৩০ জন দুর্ধর্ষ ‘স্লিপার কিলার’ জঙ্গি তৈরি করেছিলেন জিয়া।
আইএ/এএল