প্রকাশিত: নভেম্বর ২১, ২০২২, ০২:৩৪ এএম
নিখুঁত পরিকল্পনা আর ফিল্মি স্টাইলে আবারো জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলো। এবারও পুলিশকে আহত করে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুর্ধর্ষ দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়া হলো। প্রথমবার সড়কে হলেও এবার প্রকাশ্য। আদালত পাড়ার মত বিপুল জনসমাগম এলাকা থেকে মাত্র ৫/৭ মিনিটেই পুলিশকে আহত করে জঙ্গিরা তাদের দুই নেতাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, যারা ছিনিয়ে নিয়েছে এবং যারা পালিয়েছে উভয়ই প্রশিক্ষিত। ছিনিয়ে নিতে অন্তত ১০/১২ জন জঙ্গি ছিল। তবে মূল ঘটনায় ছিলো ৪ জন। এমন ঘটনায় হতবাক যেমন আদালত পাড়ার লোকজন তেমনি হতবাক পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। তবে পুলিশ ছিনিয়ে নেয়া জঙ্গিদের দ্রুত গ্রেফতারে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন।
সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যান থেকে জেএমবির তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার প্রথম ঘটনা ঘটে। জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের এ তিন নেতা হলেন, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি (৩৮) ও রাকিবুল হাসান ওরফে হাফেজ মাহমুদ (৩৫) এবং যাবজ্জীবন সাজার আসামি জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজান (৩৫)। জঙ্গিদের গুলিতে এক পুলিশ কনস্টেবল নিহত এবং উপ পরিদর্শকসহ (এসআই) দুই পুলিশ সদস্য আহত হন।
জানা যায়, কাশিমপুর কারাগার থেকে পুলিশের একটি প্রিজন ভ্যান আসামি নিয়ে ময়মনসিংহ আদালতে যাচ্ছিল। সকাল সোয়া ১০টায় পথে ত্রিশালের সাইনবোর্ড এলাকায় মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কার প্রিজন ভ্যানকে ব্যারিকেড দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ও বোমা হামলা চালায়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গোলাগুলি হয়।এ সময় দুর্বৃত্তদের এলোপাতাড়ি গুলি ও বোমার আঘাতে আতিকুর রহমান (৩২) নামে পুলিশের এক কনস্টেবল নিহত ও দুই পুলিশ সদস্য আহত হন। ওই সময় জঙ্গিরা ১০ মিনিটের বেশি সময় নেয়নি।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটলো রোববার (২০ নভেম্বর) দুপুরে। এদিন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিদের ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এবার জঙ্গিরা পিপার স্প্রে ব্যবহার করে। স্প্রে ব্যবহারের ফলে পুলিশ সদস্যরা চোখে আর কিছু দেখতে পাননি সাথে জ্বালাও পোড়াও করছিল। ছিনিয়ে নেয়া জঙ্গিরা হলো মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব সাজিদ। শামীমের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতকের মাধবপুর গ্রামে। সোহেলের বাড়ি লালমনিরহাটের আদিতমারীর ভেটোশ্বর গ্রামে। তারা জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটের দিকে চার আসামি কোর্টে হাজিরা দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের নিয়ে যাচ্ছিলেন একজন পুলিশ এবং একজন আনসার সদস্য। গেটের সামনে আসার পরপরই ওই ৪ আসামি পুলিশ ও আনসার সদস্যকে কিল-ঘুষি মারতে শুরু করে। বাইরে আরও চারজন লোক ছিল বাইক নিয়ে। ঘুষি দেওয়ায় পুলিশ সদস্য আহত হন এবং তার শরীর থেকে রক্ত বের হয়। যার ফলে তার হাতে থাকা দুই আসামি ছেড়ে দেন তিনি। আনসার সদস্য তার হাতে থাকা দুই আসামিকে ছাড়েননি। তাকে অনেক মারধর করা হয়েছে। তাকেও ঘুষি দেওয়া হয়েছে, স্প্রে মারা হয়েছে। কিন্তু তিনি আসামি ছাড়েননি। পুলিশ সদস্য যে দুই আসামিকে ছেড়ে দিয়েছেন তারা বাইরে রাখা মোটরসাইকেলে উঠে চলে যায়।
তিনি আরও বলেন, রাস্তার বিপরীত পাশ থেকে মোটরসাইকেলে থাকা লোকেরা সিগন্যাল দেওয়ার পরই গেটের কাছে এসে আসামিরা পুলিশকে কিলঘুষি দেওয়া শুরু করে। এর মধ্যে গেটের দারোয়ান ধরতে এলে তাকেও স্প্রে মারা হয়, তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পার্কিংয়ে আরও ৩ জন ড্রাইভার ছিলেন, তাদেরও স্প্রে মেরে অজ্ঞান করা হয়। পথচারী ছিলেন অনেক, তাদের মধ্যে প্রথম কয়েকজনকে স্প্রে মারার পর বাকি পথচারীরা সরে যান। স্প্রে মারে, আর অজ্ঞান হয়ে যায়, এটা দেখে আর কেউ ভয়ে আগায়নি। বাইরে ওনাদের যে লোকজন ছিল তারাও হয়তো চাকু-ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এজন্য আমিও সামনে যাইনি।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, মোটরসাইকেলে ছিল ৪ জন। বাকি কয়েকজন ছিল আশপাশে। তাদের মুখে মাস্ক ছিল। বয়স ২০/২৫ বছরের মত হবে। সবাই তরুন। ঘটনা দেখে যা মনে হয়েছে ওদের ১০/১২ লোক ছিল। সবমিলিয়ে ৫ মিনিটের মত ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ ঘটনার আকস্মিকতা ও স্প্রে মারা দেখে অনেকে ভয়ে এগিয়ে আসেনি। প্রথমে অনেকে বোঝেইয়নি তারা জঙ্গি ছিল। পরে লোকজন বলছে তারা জঙ্গি।
ওই প্রত্যক্ষদর্শী আরো বলেন, ওদের নিকট অস্ত্রও থাকতে পারে। সবারই ব্যাগ ছিল। হয়তো বড় কিছু হলে ফায়ার করতে পারতো। তারা যেহেতু জঙ্গি অবশ্যই অস্ত্র নিয়ে আসতে পারে এতে কোন সন্দেহ নাই।
এদিকে এমন ঘটনায় হতবাক সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সাধারণ মানুষ বলছেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিদের ব্যাপারে ওই ধরনের কোন নিরাপত্তাই ছিলনা। অন্তত আরো পুলিশ থাকলে এভাবে ঘটনা ঘটার সুযোগ থাকতো।
পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এমনই মতামত দিয়েছেন। এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ক্ষেত্রে সামনে পেছনে পুলিশের কর্ডন থাকা আবশ্যিক। কিন্তু এখানে কি ফলো করা হয়েছে তা বোঝা যাচ্ছেনা। একজন পুলিশ আর একজন আনসার কেন থাকবে সেটি গভীরভাবে তদন্ত করতে হবে। পুলিশের গাফিলতি থাকলে তাও বের করতে হবে।
এ ঘটনায় ঢাকাজুড়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ। এছাড়া ঢাকার প্রতিটি প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালাতে বলা হয়েছে। দুপুরে ডিএমপি সদরদপ্তর থেকে ঢাকার সব বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি), থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ওয়াকিটকিতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় ২০ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে পুলিশ সূত্র নিশ্চিত করেছে।
অন্যদিকে ছিনিয়ে দুই জঙ্গিকে ধরতে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান ডিআইজি আসাদুজ্জামান বলেন, পুলিশের সবকটি ইউনিট আসামিদের গ্রেফতারে কাজ করছে। দ্রুত সময়ের মধ্যেই গ্রেফতার সম্ভব হবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুনুর রশিদ বলেন, এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমরা আসামিদের গ্রেফতারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ঘটনায় ১০/১২ জন জঙ্গি অংশ নিয়ে থাকতে পারে। ঘটনার পর সিসিটিভি ফুটেজসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের মতামতে মনে হয়েছে তাদের ১০/১২ জনের মত সংখ্যা ছিল। আর অবশ্যই প্রশিক্ষিত না হলে এ রকম স্থান থেকে আসামি ছিনিয়ে নেয়ার মত ঘটনা ঘটানোর সাহস পেতনা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ঘটনার সাথে সাথে আমরা রেড অ্যালার্ট জারি করেছি। সীমান্তেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারে। দ্রুত সময়ের মধ্যেই গ্রেফতার হবে বলে আমরা আশা করছি।
আইএ/