প্রকাশিত: নভেম্বর ১৬, ২০২২, ০৭:২০ পিএম
কয়েক বছর আগেও চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার এরশাদপুর গ্রামে তাঁতশিল্প ছিল জমজমাট। হাতের তাঁতের খট খট শব্দে মুখরিত থাকতো গ্রামটি। কিন্তু বর্তমানে সুতার দাম বৃদ্ধি, কঠোর পরিশ্রমে কম মজুরি আর যান্ত্রিক তাঁতযন্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বাপ-দাদার পৈত্রিক পেশা বদল করছেন তাঁতীরা। কালের বিবর্তনে আজ বিলুপ্তির পথে আলমডাঙ্গা উপজেলার ঐতিহ্যবাহী এ তাঁতশিল্প।
আলমডাঙ্গার এরশাদপুর গ্রামসহ ১৫-১৬টি গ্রামের কয়েক হাজার বাসিন্দা এক সময় তাঁত বুনে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আগে ওই এলাকার প্রতিটি ঘরে ঘরে তাঁত থাকলেও বর্তমানে মাত্র ৩০-৪০টি পরিবারে তাঁত রয়েছে। এরশাদপুর গ্রামের কয়েকজন মানুষ বাপ-দাদার পেশা টিকিয়ে রাখতে তাঁতের কাজ করেন। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ তাঁতীসহ সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা বেকার হয়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন। তাঁতীরা কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ রাজমিস্ত্রির সহকারী, কেউ রিকশাভ্যান চালক, আবার কেউ মুদি দোকানে কাজ করছেন।
তাঁতীরা জানান, একসময় এরশাদপুর গ্রামের পাঁচ শতাধিক তাঁতী পরিবার ছিল। প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাঁত শিল্পের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখানকার তৈরি লুঙ্গি, গামছা ও তোয়ালের ব্যাপক চাহিদা ছিল। আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনের পাশে তাঁতের তৈরি কাপড়ের বড় বাজার ছিল। এখন শুধু গামছা তৈরি করে তাঁত শিল্পের অস্তিত্ব কোনো রকম টিকিয়ে রেখেছেন কেউ কেউ।
তাঁতীদের দুরাবস্থার কারণ সম্পর্কে তাঁতীরা জানান, কাঁচামাল ও সুতার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে কাপড়ের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় তাঁতের তৈরি কাপড়ের মূল্য বাড়েনি। সারাদিন কাজ করে ৪ পিছ গামছা তৈরি করে আয় হয় ৪০-৫০ টাকা। অন্যদিকে যন্ত্রচালিত তাঁতযন্ত্রের কাপড় বাজারে আসায় হাতের তাঁতের তৈরি কাপড়ের চাহিদা কমে গেছে। তাই সহজে কাপড়ের দামও বাড়ানো যায় না। এ কারণে অনেকেই হাতে চালানো তাঁত মেশিন কম দামে বিক্রি করে দিয়েছেন। অনেকেই বাড়িতে ফেলে রেখেছেন।
তাঁতি তসলিমা খাতুন (৪০) জানান, ‘আমি দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে তাঁতের কাজ করি। এ কাজে তেমন লাভ হয় না। আমি মাঝে মাঝে সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে দিনে ৪টি গামছা তৈরি করি। সুতার দাম বেশি কিন্তু কাপড়ের দাম কম। এতে আমার সারাদিনে লাভ হয় মাত্র ৪০-৫০ টাকা’
গ্রামের ৬০ বছরের বৃদ্ধা তাঁতী খাদিজা খাতুন বলেন, ‘আমি দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে এ কাজের সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে তাঁতের কাজ করে সংসার টিকানো কঠিন। তাই বাড়ির পুরুষরা তাঁতের কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। অতিতে তাঁতের কাজ করে অনেক লাভবান হয়েছি। কিন্তু এখন এ পেশায় থাকা অনেক কঠিন। বাড়ির মহিলারা কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাঁতের কাজ করছে।`
গ্রামের ৬০ বছরের বৃদ্ধা তাঁতী জহুরা খাতুন বলেন, ‘ আমি দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে তাঁতের কাজ করছি। আগে লাভ বেশি হতো তখন তাঁতের কাজ ভালোভাবে করতে পেরেছি। এখন সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে ৩০-৪০ টাকা আয় হয়। বাধ্য হয়েই কাজ ছেড়ে দিতে হচ্ছে।
তাঁতি ইদ্রিস আলী বলেন, ‘আমরা তাঁতীরা বাধ্য হয়েই পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছি। আগে তাঁতের কাজ করে যে পরিমাণ লাভবান হয়েছি এখন আর সম্ভব হয় না। তাঁতশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে তাঁতীদের আধুনিক প্রশিক্ষণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং তাঁতীদেরকে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।’
তাঁতী আব্দুল মান্নান বলেন, ‘তাঁতের পেশা ছেড়ে এখন রাজমিস্ত্রির কাজ বেছে নিয়েছি। তাঁতীদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করে এবং রঙ ও সুতা ভর্তুকি মূল্যে দেয় তাহলে তাঁত শিল্প টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে’।
এ পেশায় আয় কমে যাওয়ায় তাঁতীরা পেশা বদলে কেউ হয়েছেন কুলি, মজুর, রিকশাচালক, দিনমজুর, রাজমিস্ত্রী, মুদি দোকানী। বাড়িতে বাড়িতে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে ঐতিহ্যবাহী তাঁতযন্ত্র। কেউ কেউ কম দামে বিক্রি করে দিচ্ছেন তাঁতযন্ত্র। হাতেগোনা কয়েকটি বাড়িতে নারীরা অবসরে তাঁত বুনে বাঁচিয়ে রেখেছেন ঐতিহ্যবাহী এ পেশা।
আলমডাঙ্গা কেন্দ্রিয় তন্তুবায় শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু মুছা বলেন, ‘আমাদের এলাকায় অতিতে অনেক মানুষ এই তাঁত পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। বর্তমানে সুতা, রং ও কাঁচামালের দাম অধিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মজুরী ও লাভ কম হওয়ার কারণে তাঁত শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই বাধ্য হয়েই অনেকে তাদের বাপ দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। তাঁতী সম্প্রদায় এবং হাতের তাঁতের শিল্প এই এলাকা থেকে বিলীন হয়ে যাওয়ার দাঁরপ্রান্তে। সরকার যদি প্রণোদনা ও ভর্তুকির মাধ্যমে তাঁতীদের পাশে দাড়ান তাহলে এই শিল্পটাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো’।
চুয়াডাঙ্গা বিসিক জেলা কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক মো. সামসুজ্জামান বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় এক সময় প্রচুর তাঁতি ছিল। এখন তাঁতীরা বাধ্য হয়ে তাদের পেশা বদলে ফেলছে। যন্ত্রের তাঁতের সঙ্গে হাতের তাঁত পেরে উঠছে না। তাদের আধুনিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তাঁতীরা যদি বিসিকের কাছে আসেন, তারা যদি কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা চান, তবে বিসিক অবশ্যই পাশে থাকবে এবং তাদের যথাযথ সাহায্য সহায়তা করবে’।
এসএই/এএল